Sleeping with Kajal Eye Problems: আমাদের দেশে কাজল বা কোহল ব্যবহারের ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। বিশেষ করে নারীদের সৌন্দর্যচর্চায় কাজলের ব্যবহার এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে অনেকেই কাজল ছাড়া নিজেদের অসম্পূর্ণ মনে করেন। তবে চোখে কাজল লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আপনার চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘ সময় চোখে কাজল রেখে দেওয়া বিভিন্ন ধরনের চোখের সমস্যার কারণ হতে পারে। আজকের এই লেখায় আমরা জানবো চোখে কাজল রেখে ঘুমালে কী কী সমস্যা হতে পারে এবং কীভাবে এসব সমস্যা এড়ানো যায়।
কাজল কেন চোখের জন্য সমস্যার কারণ হয়
আমাদের নিচের চোখের পাতায় প্রায় ৩০-৩৫টি তেল গ্রন্থি রয়েছে যা চোখের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য তেল নিঃসরণ করে। এই তেল চোখের অশ্রুর সাথে মিশে চোখকে সুরক্ষিত রাখে এবং পরিবেশগত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। কিন্তু যখন আমরা চোখের ভেতরের অংশে কাজল লাগাই, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ তেল গ্রন্থিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চোখের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা নষ্ট হয় এবং বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
চোখে জ্বালাপোড়া ও অ্যালার্জি
দীর্ঘ সময় চোখে কাজল রেখে দিলে সবচেয়ে সাধারণ যে সমস্যাটি হয় তা হলো চোখে জ্বালাপোড়া ও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। বাজারে পাওয়া অনেক কাজলেই সীসা বা অন্যান্য ভারী ধাতু থাকে যা চোখের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব উপাদান চোখে লাগাতার থাকলে চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চুলকানি, ফুলে যাওয়া এবং চোখের চারপাশে ফুসকুড়ি হতে পারে। অনেক সময় এই অ্যালার্জির কারণে চোখ থেকে অতিরিক্ত পানি বের হতে থাকে।
সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি
চোখে কাজল লাগিয়ে ঘুমানোর অন্যতম বড় বিপদ হলো সংক্রমণের ঝুঁকি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান যে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫-৬ জন রোগী কসমেটিক সংক্রান্ত চোখের সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে আসেন। এর মধ্যে রয়েছে কনজাংকটিভাইটিস (চোখ ওঠা), স্টাই এবং অন্যান্য চোখের প্রদাহজনিত রোগ। কাজলে যদি ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক জন্মায় এবং তা দীর্ঘ সময় চোখে থাকে, তাহলে মারাত্মক সংক্রমণ হতে পারে।
কনজাংকটিভাইটিসের লক্ষণসমূহ:
-
চোখ লাল হয়ে যাওয়া
-
চোখে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া
-
চোখ থেকে পুঁজ বা অস্বাভাবিক স্রাব নিঃসরণ
-
চোখের পাতা ফুলে যাওয়া
-
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
অশ্রু গ্রন্থি বন্ধ হয়ে যাওয়া ও শুষ্ক চোখের সমস্যা
চোখের ওয়াটারলাইনে কাজল লাগানোর ফলে অশ্রু গ্রন্থি বা টিয়ার ডাক্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই গ্রন্থিগুলো চোখের উপরের এবং নিচের পাতার ভেতরের দিকে অবস্থিত। যখন এগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন চোখে প্রাকৃতিক তেল এবং অশ্রুর সঠিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে চোখ শুষ্ক হয়ে যায়, প্রদাহ হয় এবং স্টাই বা যব হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। শুষ্ক চোখের সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
কর্নিয়ায় ক্ষত ও দৃষ্টি সমস্যা
কাজল লাগানোর সময় যদি পেনসিলের মুখ বা কাজলের কণা সরাসরি চোখের মণির (কর্নিয়া) সংস্পর্শে আসে, তাহলে কর্নিয়ায় আঁচড় বা ক্ষত হতে পারে। এই ধরনের ক্ষতের কারণে তীব্র ব্যথা, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘ সময় কাজল চোখে রাখলে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। কখনো কখনো কাজলের কণা চোখের ভেতরে গিয়ে অস্থায়ী দৃষ্টি সমস্যার সৃষ্টি করে।
চোখের পাপড়ি নষ্ট হওয়া
নিয়মিত কাজল ব্যবহার এবং তা রাতে না মুছে ঘুমানোর ফলে চোখের পাপড়ি দুর্বল হয়ে যায়। প্রতিদিন কাজল লাগানো এবং তা তোলার প্রক্রিয়ায় পাপড়িতে চাপ পড়ে। দীর্ঘ সময় কাজল চোখে রাখলে পাপড়ি ভেঙে যেতে পারে বা পড়ে যেতে পারে। এর ফলে পাপড়ি পাতলা হয়ে যায় এবং অসমান দেখায়। চোখের সৌন্দর্যের জন্য ব্যবহৃত কাজলই উল্টো চোখের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দিতে পারে।
ছিদ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া ও মিলিয়া
ওয়াটারলাইনে কাজল লাগানোর ফলে চোখের পাতার প্রান্তে থাকা ছোট ছোট ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে মিলিয়া নামক ছোট সাদা দানার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া চোখের চারপাশের ত্বকে ব্রণ বা অন্যান্য ত্বকের সমস্যা হতে পারে। যারা আগে থেকেই ত্বকের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরো বেশি দেখা দেয়।
সীসার বিষক্রিয়া
ঐতিহ্যবাহী কাজল এবং কিছু নিম্নমানের কাজলে সীসা থাকতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এই ধরনের কাজল ব্যবহার করলে শরীরে সীসার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সীসার বিষক্রিয়ার ফলে রক্তাল্পতা, বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। আমেরিকার মতো দেশে সীসাযুক্ত কসমেটিক নিষিদ্ধ হলেও ভারতে এখনো অনেক কোম্পানির কাজলে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সীসা পাওয়া যায়।
ত্বকের রঙ পরিবর্তন
কিছু কাজলের ফর্মুলায় এমন উপাদান থাকে যা ত্বকের রঙ পরিবর্তন করতে পারে। বিশেষ করে যদি কাজল ছড়িয়ে পড়ে বা চোখের চারপাশের ত্বকে লেগে থাকে তাহলে কালো দাগ বা ধূসর রঙের ছাপ পড়তে পারে। এই সমস্যা বিশেষভাবে দেখা যায় তাদের ক্ষেত্রে যারা রাতে কাজল না মুছে ঘুমান।
মানসিক নির্ভরশীলতা
নিয়মিত কাজল ব্যবহারকারীদের মধ্যে একধরনের মানসিক নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে। তারা কাজল ছাড়া নিজেদের অসম্পূর্ণ মনে করেন এবং কাজল না লাগিয়ে বাইরে যেতে পারেন না। এই নির্ভরশীলতার কারণে তারা অতিরিক্ত কাজল ব্যবহার করেন এবং সঠিকভাবে তা পরিষ্কার করেন না।
নিরাপদ কাজল ব্যবহারের উপায়
গুণগত মানসম্পন্ন কাজল নির্বাচন করুন
বিশ্বস্ত ব্র্যান্ডের কাজল কিনুন যেগুলোতে ইকোমার্ক আছে। এই মার্ক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। সীসামুক্ত এবং জল-ভিত্তিক কাজল ব্যবহার করুন কারণ এগুলো সহজে পরিষ্কার হয়ে যায়।
প্রতিদিন রাতে পরিষ্কার করুন
ঘুমানোর আগে অবশ্যই মেকআপ রিমুভার দিয়ে কাজল পরিষ্কার করুন। শুধু পানি দিয়ে ধোয়া যথেষ্ট নয়। তেল-ভিত্তিক কাজলের জন্য বিশেষ মেকআপ রিমুভার ব্যবহার করুন।
কাজল শেয়ার করবেন না
অন্যের সাথে কাজল শেয়ার করলে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। নিজের কাজল নিজেই ব্যবহার করুন।
নিয়মিত কাজল পরিবর্তন করুন
ছয় মাস পর পর কাজল পরিবর্তন করুন। পুরনো বা মেয়াদোত্তীর্ণ কাজল ব্যবহার করবেন না।
চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নিবেন
যদি চোখে জ্বালাপোড়া, লালচে ভাব, ফোলাভাব বা কোনো ধরনের স্রাব দেখা দেয় তাহলে অবিলম্বে চোখের চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বিশেষ করে যদি এই সমস্যাগুলো কাজল ব্যবহার বন্ধ করার পরেও না কমে তাহলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
চোখে কাজল রেখে ঘুমানো একটি ক্ষতিকর অভ্যাস যা দীর্ঘমেয়াদে আপনার চোখের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তাই সৌন্দর্যের পাশাপাশি চোখের সুস্বাস্থ্যের কথাও মাথায় রেখে কাজল ব্যবহার করুন এবং প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই তা পরিষ্কার করুন। মনে রাখবেন, প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা।