India stealth fighter 5th gen: ভারতের প্রতিরক্ষা ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত এসেছে। গত মঙ্গলবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশের প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার জেট তৈরির প্রকল্পে সবুজ সংকেত দিয়েছেন। অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফট (AMCA) নামের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে এবার শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL) নয়, বরং টাটা, আদানি সহ দেশীয় বেসরকারি কোম্পানিগুলোও অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এই সিদ্ধান্ত ভারতের আকাশসীমা রক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং দেশের প্রতিরক্ষা খাতে বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করবে।
AMCA প্রকল্পের মূল বৈশিষ্ট্য
AMCA হবে ভারতের প্রথম পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান যা অত্যাধুনিক স্টেলথ প্রযুক্তি, সুপারক্রুজ ক্ষমতা এবং অত্যাধুনিক অ্যাভিওনিক্স সিস্টেম দিয়ে সজ্জিত হবে। এই যুদ্ধবিমানটি একযোগে বায়ু-থেকে-বায়ু এবং বায়ু-থেকে-ভূমি উভয় ধরনের যুদ্ধ মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ADA) এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দেবে এবং শিল্প অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, এই পদ্ধতি সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতকে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে সমান সুযোগ প্রদান করবে।
প্রতিযোগিতায় নামছে বেসরকারি খাত
এতদিন HAL-এর একচেটিয়া আধিপত্যে থাকা যুদ্ধবিমান তৈরির ক্ষেত্রটিতে এবার বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরাসরি প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পাবে। টাটা গ্রুপ, আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস সহ অন্যান্য ভারতীয় কোম্পানিগুলো এককভাবে, যৌথ উদ্যোগ অথবা কনসোর্টিয়াম হিসেবে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য দরপত্র জমা দিতে পারবে।
এই উদ্যোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ HAL ইতিমধ্যে তেজস লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফটের ধীরগতির উৎপাদনের জন্য সমালোচিত হয়েছে। বর্তমানে HAL বছরে সর্বোচ্চ ১২টি তেজস যুদ্ধবিমান তৈরি করতে পারে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১৮টি এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ২৪টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
কৌশলগত গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ভারতীয় বিমানবাহিনীর বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলে AMCA প্রকল্পের জরুরি প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত IAF-এর রয়েছে মাত্র ৩১টি যুদ্ধবিমান স্কোয়াড্রন, যেখানে অনুমোদিত সংখ্যা ৪২টি। এই ঘাটতি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কার অবস্থার সমান।
পাকিস্তানের সাথে সাম্প্রতিক সংঘাতের পর এবং চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির মুখে ভারতের বিমান শক্তি বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। চীন ইতিমধ্যে তার J-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট পাকিস্তানে সরবরাহের পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে, যা এই অঞ্চলের বিমান শক্তির ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও বৈশিষ্ট্য
AMCA হবে একটি ২৫ টন ওজনের টুইন-ইঞ্জিন যুদ্ধবিমান যাতে থাকবে ডাইভার্টলেস সুপারসনিক ইনটেক – একটি স্বদেশী উদ্ভাবন। এই বিমানটি চারটি দীর্ঘপাল্লার বায়ু-থেকে-বায়ু ক্ষেপণাস্ত্র এবং একাধিক নির্ভুল নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র বহন করতে সক্ষম হবে।
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে:
- উন্নত স্টেলথ ক্ষমতা যা শত্রুর রাডার এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে
- সুপারক্রুজ প্রযুক্তি যা আফটারবার্নার ছাড়াই সুপারসনিক গতিতে উড়তে পারে
- অত্যাধুনিক সেন্সর ফিউশন সিস্টেম
- ইন্টিগ্রেটেড ব্যাটল নেটওয়ার্ক ক্ষমতা
সময়সূচি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
AMCA প্রকল্পের প্রথম প্রোটোটাইপের প্রথম উড্ডয়ন ২০২৮ সালের শেষ নাগাদ প্রত্যাশিত। সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নে দশ বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে এই যুদ্ধবিমানের ব্যাপক উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা।
DRDO চেয়ারম্যান সমীর ভি কামাত জানিয়েছেন যে AMCA-এর ডিজাইন পর্যায় সম্পূর্ণ হয়েছে এবং এখন প্রোটোটাইপ তৈরির অপেক্ষায় রয়েছে। ইঞ্জিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিদেশী সহযোগিতার মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও কর্মসংস্থান
AMCA প্রকল্প শুধু প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এই প্রকল্প হাজার হাজার উচ্চদক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং ভারতের অ্যারোস্পেস শিল্পের বিকাশে অবদান রাখবে।
বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ প্রযুক্তি হস্তান্তর, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এতে করে আমদানি নির্ভরতা কমে দেশের আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও প্রতিযোগিতা
বর্তমানে বিশ্বে মাত্র কয়েকটি দেশ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করতে সক্ষম। আমেরিকার F-২২ র্যাপ্টর ও F-৩৫ লাইটনিং II, রাশিয়ার Su-৫৭ এবং চীনের J-২০ ও J-৩৫ এই তালিকায় রয়েছে।
AMCA প্রকল্প সফল হলে ভারত এই এলিট ক্লাবে যোগ দেবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগও পাবে। এটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠবে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের পথ
AMCA প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রযুক্তিগত জটিলতা, দীর্ঘ উন্নয়ন সময়, উচ্চ ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা প্রধান বাধা। তবে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।
প্রকল্পের সফলতার জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP) মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে, যা ঝুঁকি ভাগাভাগি এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
AMCA প্রকল্প ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। হ্যালের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসানের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, যা গুণমান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। টাটা, আদানি সহ বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ এই প্রকল্পে নতুন গতি সঞ্চার করবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত আকাশযুদ্ধে নতুন মাত্রা অর্জন করবে এবং আত্মনির্ভরশীল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।