কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একজন তরুণী চিকিৎসকের উপর নৃশংস হামলার ঘটনায় সারা রাজ্য জুড়ে চলছে প্রতিবাদের ঝড়। এই ঘটনার বিচার দাবি করে এবার অভিনব পদক্ষেপ নিল কলকাতার সোনাগাছি এলাকার যৌনকর্মীরা। তারা ঘোষণা করেছেন, এবছর দুর্গাপুজোয় তারা মাটি দেবেন না। গত কয়েকদিন ধরে চলা প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সোনাগাছির যৌনকর্মীদের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় সোনাগাছি এলাকা থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয় মূর্তি তৈরির জন্য। এই ঐতিহ্য দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু এবার নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা এই ঐতিহ্য ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আরজি কর হাসপাতালের ঘটনাটি ঘটেছিল গত সপ্তাহে। একজন তরুণী চিকিৎসক সেমিনার রুমে একা ছিলেন। সেই সময় একজন ব্যক্তি তাঁর উপর হামলা চালায়।
এই ঘটনায় চিকিৎসক মারাত্মকভাবে আহত হন। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে প্রতিবাদের ঝড়।প্রতিবাদের এই আন্দোলনে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, যোগ দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র হাইকোর্টের আইনজীবীদের মিছিলে অংশ নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, “আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে প্রশাসনের একাংশের ব্যর্থতার নানা ছবি ধরা পড়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা থেকে আরজি করের হামলা ঠেকানো— কোনও কিছুতেই পুলিশ-প্রশাসন জনতার কাছে নিজেদের ‘ক্রেডিবল’ প্রমাণ করতে পারেনি।
ফলে এই ঘটনায় প্রশাসনের উপরে জমে থাকা ক্ষোভ বাইরে চলে আসছে।”নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন এবং অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, রাজনৈতিক নানা ভুল পদক্ষেপই এই জন বিস্ফোরণের নেপথ্যের কারণ। কৌশিক সেনের মতে, “ঘটনার পর থেকে রাজ্য প্রশাসনের নানা ফাঁক নজরে পড়ছে। কখনও অকুস্থল অর্থাৎ সেমিনার রুমের কাছেই নির্মাণকাজ, কখনও প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ ইস্তফা দেওয়ার পরেও তাঁকে শহরেরই আর একটি হাসপাতালে একই পদে নিয়োগ করার মতো একাধিক পদক্ষেপ মানুষের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।”
এই প্রতিবাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন “মেয়েদের রাত দখলের” আন্দোলনের প্রথম কারিগর রিমঝিম সিনহাও। তিনি মনে করেন, দেশের নানা প্রান্তে মেয়েদের উপর ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান অত্যাচারকে সবক শেখাতেই মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রিমঝিমের কথায়, “কে বলতে পারে, কাল হয়তো আমি, পরশু অন্য কেউ টার্গেট হব না!”এই প্রতিবাদের আন্দোলন শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে অন্য রাজ্যেও, এমনকি দেশের বাইরেও। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক প্রভাব।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জনবিপ্লব ও ছাত্র সমাজের আন্দোলন এ পার বাংলার উপরে প্রভাব ফেলেছে। তৃতীয়ত, যুক্তিসঙ্গত ভাবেই হোক অথবা ফেক নিউজের মাধ্যমে— নানা তথ্যের বিস্ফোরণে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অন্য নানা ইস্যুতে জমতে থাকা ক্ষোভ এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।সোনাগাছির যৌনকর্মীদের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি প্রমাণ করে যে, সমাজের প্রতিটি অংশ এই ঘটনায় বিচারের দাবি করছে। তাদের এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করবে।এই ঘটনার প্রভাব নিঃসন্দেহে দূরপ্রসারী হবে। প্রথমত, এটি প্রমাণ করে যে, সমাজের সকল স্তরের মানুষ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
দ্বিতীয়ত, এটি প্রশাসনকে বাধ্য করবে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে। তৃতীয়ত, এটি অন্যান্য রাজ্যে এবং দেশেও প্রভাব ফেলতে পারে, যেখানে এধরনের ঘটনা ঘটছে।তবে, এই প্রতিবাদের ফলে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতিতে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, সোনাগাছি থেকে মাটি সংগ্রহ করা একটি দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ভাঙলে পুজো কমিটিগুলোকে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।সর্বোপরি, এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সমাজের প্রতিটি অংশ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, তারাও সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাদের কণ্ঠস্বরও সমান গুরুত্বপূর্ণ।এই ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, সমাজের প্রতিটি অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি।
আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা যেন শেষ হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেই আশা নিয়েই এই প্রতিবাদের আন্দোলন চলছে।তবে, এই প্রতিবাদের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আইনের শাসন বজায় রাখা জরুরি। আমরা আশা করব, কর্তৃপক্ষ দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেবে। পাশাপাশি, হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সমাজের প্রতিটি অংশের দায়িত্ব রয়েছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। সোনাগাছির যৌনকর্মীদের এই সিদ্ধান্ত সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। আমরা আশা করব, এই প্রতিবাদের ফলে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।