দক্ষিণ কলকাতার সিংহি পার্ক এলাকায় একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে যা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য এবং অসমতার চিত্র তুলে ধরেছে। একজন গরিব ফুচকা বিক্রেতার সাথে স্থানীয় দুর্গোৎসব কমিটির কিছু সদস্য এবং এলিট শ্রেণীর লোকজন অমানবিক আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ঘটনার বিবরণ অনুযায়ী, ওই ফুচকা বিক্রেতা সিংহি পার্ক দুর্গোৎসব কমিটির মেইন গেটের কাছে তার ঠেলা নিয়ে ফুচকা বিক্রি করছিলেন। এটি দেখে কমিটির কিছু সদস্য এবং স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ক্ষেপে যান। তারা ওই গরিব বিক্রেতার সাথে অভদ্র আচরণ করেন এবং তার ফুচকার ঠেলা উল্টে দেন। এতে বিক্রেতার সমস্ত ফুচকা এবং অন্যান্য উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়।
এই ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন দুর্গোৎসব কমিটির সদস্যরা। অনেকেই এই ধরনের অমানবিক আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন। একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে উৎসবের সময়েও আমরা এভাবে একজন গরিব মানুষের সাথে আচরণ করি। দুর্গা পূজার মূল বার্তাই তো সকলের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা।”
Amazon Great Indian Festival 2024: স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক্সে অবিশ্বাস্য অফার শুরু!
সমাজবিজ্ঞানী ড. অমিত সেন এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “এটি আমাদের সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী বৈষম্যের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। যারা নিজেদেরকে উচ্চবিত্ত বা এলিট মনে করেন, তারা প্রায়শই গরিব ও সাধারণ মানুষের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেন। এটি একটি গভীর সামাজিক সমস্যা যা সমাধান করা প্রয়োজন।”
ঘটনার পর দুর্গোৎসব কমিটি থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে যেখানে তারা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন যে ওই ফুচকা বিক্রেতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তবে এই দাবির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং কমিটির ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট করা হয়েছে যেখানে তারা নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে নাটকীয়ভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এই ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি শুধুমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সমাজে বিদ্যমান গভীর বৈষম্যের প্রতিফলন। একজন সামাজিক কর্মী বলেন, “আমরা প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে দুর্গা পূজা করি, কিন্তু মা দুর্গার আদর্শকে কতটা অনুসরণ করি সেটাই প্রশ্ন।”
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কলকাতায় প্রতি বছর প্রায় ৪০০০ দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং এর জন্য গড়ে প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি শহরে প্রায় ৫ লক্ষ পথবাসী রয়েছে যারা দৈনিক খাবারের জন্য সংগ্রাম করে।
সমাজকর্মী রুমা চক্রবর্তী বলেন, “আমরা যদি এই বিপুল অর্থের একটি ছোট অংশও গরিব মানুষদের কল্যাণে ব্যয় করতাম, তাহলে অনেক মানুষের জীবনমান উন্নত হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা শুধু বাহ্যিক আড়ম্বরেই বেশি মনোযোগী।”
এই ঘটনার পর অনেকেই দাবি তুলেছেন যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। একজন আইনজীবী জানান, “এটি স্পষ্টতই একটি অপরাধমূলক কাজ। ওই ব্যক্তির সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
তবে এখনও পর্যন্ত পুলিশ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একজন পুলিশ কর্মকর্তা শুধুমাত্র এটুকু জানিয়েছেন যে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।
এদিকে, স্থানীয় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে যে শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই চলবে না, এই ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সেজন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা বলছেন, প্রতিটি দুর্গা পূজা কমিটিকে একটি আচরণবিধি মেনে চলতে হবে যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে যে কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ বরদাস্ত করা হবে না।
ফোন-ল্যাপটপে ৭৫% পর্যন্ত ছাড়! আসছে Amazon Great Indian Festival – জেনে নিন সব খুঁটিনাটি
সমাজবিজ্ঞানী ড. সুদীপ্ত ঘোষ মনে করেন, “এই ঘটনাটি আমাদের সমাজের একটি গভীর ক্ষতের দিকে আঙুল তুলে ধরেছে। আমরা যতই আধুনিক হওয়ার দাবি করি না কেন, আমাদের মধ্যে এখনও জাতিভেদ, শ্রেণীভেদের মানসিকতা রয়ে গেছে। এটি পরিবর্তন করতে হলে শুধু আইন নয়, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।”
এই ঘটনাটি আমাদের সকলকে ভাবিয়ে তোলে যে আমরা কতটা সভ্য ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি। দুর্গা পূজার মতো একটি মহান উৎসবের সময়ও যদি আমরা এভাবে একজন গরিব মানুষের সাথে আচরণ করি, তাহলে আমাদের সভ্যতার দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত?
অনেকে মনে করছেন, এই ঘটনাটি শুধু সিংহি পার্কের নয়, সমগ্র সমাজের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে উন্নয়ন ও প্রগতির পাশাপাশি আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমাদের উন্নয়ন ও আধুনিকতার দাবি অর্থহীন হয়ে পড়বে।
শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনাটি আমাদের সকলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে – আমরা কি সত্যিই একটি সমতাভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তুলতে চাই, নাকি শুধুমাত্র বাহ্যিক উন্নয়নের পিছনে ছুটতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হয়তো আমরা আমাদের সমাজের একটি নতুন দিগন্ত খুঁজে পাব।