মহাকাশে নতুন দিগন্ত: স্পেসএক্সের স্টারশিপের ঐতিহাসিক দশম পরীক্ষামূলক উড়ান, সফল পেলোড উৎক্ষেপণ ও সমুদ্রে অবতরণ!

অবশেষে সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স (SpaceX)। বারবার ব্যর্থতার পর, তাদের তৈরি বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপ (Starship) তার…

Srijita Ghosh

 

অবশেষে সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স (SpaceX)। বারবার ব্যর্থতার পর, তাদের তৈরি বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপ (Starship) তার দশম পরীক্ষামূলক উড়ানে (10th test flight) ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে। এই সফল মিশনের মাধ্যমে স্পেসএক্স কেবল তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতাই প্রমাণ করল না, বরং চাঁদ এবং মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর স্বপ্নকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।

মঙ্গলবার, ২৬শে আগস্ট, ২০২৫ তারিখে টেক্সাসের স্টারবেস (Starbase) থেকে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে (ভারতীয় সময় বুধবার সকাল ৬ টা) এই বিশাল রকেটটি মহাকাশের উদ্দেশে পাড়ি দেয়। প্রায় ৬৬ মিনিটের এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রার পর, স্টারশিপ সফলভাবে ভারত মহাসাগরে অবতরণ (splashdown) করে। এই মিশনটি শুধুমাত্র একটি সফল উড়ান ছিল না, এটি ছিল স্পেসএক্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

এক নজরে স্টারশিপের দশম উড়ান: সাফল্য ও নতুনত্ব

এই পরীক্ষামূলক উড়ানের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল, যার প্রতিটিই স্পেসএক্স সফলভাবে সম্পন্ন করেছে:

সফল উৎক্ষেপণ ও বুস্টার পৃথকীকরণ: স্টারশিপের সুপার হেভি বুস্টার (Super Heavy booster) তার ৩৩টি র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন (Raptor engines) একসাথে জ্বালিয়ে প্রায় ৪০৩ ফুট (১২৩ মিটার) লম্বা এই রকেটকে পৃথিবীর মাটি থেকে সফলভাবে উত্তোলন করে। উৎক্ষেপণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই, স্টারশিপের আপার স্টেজটি সফলভাবে বুস্টার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা ‘হট-স্টেজিং’ (hot-staging) নামে পরিচিত।

বুস্টারের সফল অবতরণ: সুপার হেভি বুস্টারটি এরপর মেক্সিকো উপসাগরে (Gulf of Mexico) তার পূর্বনির্ধারিত স্থানে সফলভাবে অবতরণ করে। এটি স্পেসএক্সের পুনঃব্যবহারযোগ্য (reusable) রকেট প্রযুক্তির একটি বড় সাফল্য, যা মহাকাশ অভিযানের খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনবে।

প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ: এই মিশনেই প্রথমবার স্টারশিপ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে পেলোড (payload) ছাড়া হয়। আটটি স্টারলিংক স্যাটেলাইটের (Starlink satellites) মতো দেখতে নকল উপগ্রহ (mock satellites) সফলভাবে মহাকাশে স্থাপন করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে স্টারশিপ ভবিষ্যতে বড় আকারের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং অন্যান্য মহাকাশযান মহাকাশে পৌঁছে দিতে সক্ষম।

র‍্যাপ্টর ইঞ্জিনের পুনঃপ্রজ্জ্বলন: মহাকাশে স্টারশিপের র‍্যাপ্টর ইঞ্জিনটিকে পুনরায় চালু করা হয়, যা भविष्यে চাঁদ বা মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

নিয়ন্ত্রিত অবতরণ: পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশের সময় স্টারশিপের হিট শিল্ড (heat shield) মারাত্মক তাপমাত্রার মোকাবিলা করে এবং তার চারটি ফ্ল্যাপ (flaps) ব্যবহার করে সফলভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অবশেষে, ইঞ্জিন পুনরায় চালু করে এটি ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রিতভাবে অবতরণ করে, যা ছিল এই মিশনের সবথেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ।

ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা: স্পেসএক্সের “ফেল ফাস্ট, লার্ন ফাস্ট” দর্শন

স্টারশিপের এই সাফল্য রাতারাতি আসেনি। এর আগে বেশ কয়েকটি পরীক্ষামূলক উড়ান ব্যর্থ হয়েছিল। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রথম পরীক্ষামূলক উড়ানটি উৎক্ষেপণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিস্ফোরিত হয়। এরপরের প্রচেষ্টাগুলোতেও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দেয়। কিন্তু স্পেসএক্স তাদের “ফেল ফাস্ট, লার্ন ফাস্ট” (fail fast, learn fast) নীতিতে অটল ছিল। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা তাদের ডিজাইনে পরিবর্তন এনেছে এবং অবশেষে এই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেছে।

বিশেষ করে, আগের ফ্লাইটগুলোতে হিট শিল্ড এবং ফ্ল্যাপের স্থায়িত্ব নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। দশম ফ্লাইটে এই অংশগুলোকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছিল এবং তার ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া গেল।

ভবিষ্যতের পথে: চাঁদ, মঙ্গল এবং তারও পরে

স্টারশিপের এই সাফল্য শুধুমাত্র একটি পরীক্ষামূলক উড়ানের সাফল্য নয়, এটি মানবজাতির মহাকাশ অভিযানের ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন দরজা খুলে দিল। নাসার (NASA) আর্টেমিস প্রোগ্রামের (Artemis program) অধীনে ২০২৭ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য স্টারশিপকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এর বিশাল আকার এবং পুনঃব্যবহারযোগ্যতার কারণে, এটি একসঙ্গে অনেক মহাকাশচারী এবং প্রচুর পরিমাণে সরঞ্জাম চাঁদে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

ইলন মাস্কের স্বপ্ন আরও বড়। তিনি মঙ্গল গ্রহে একটি স্বনির্ভর মানব বসতি স্থাপন করতে চান এবং স্টারশিপ হলো সেই স্বপ্নের চাবিকাঠি। স্টারশিপের মাধ্যমে মঙ্গলে মানুষ এবং সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাঠানো সম্ভব হবে।

গাণিতিক তথ্য ও পরিসংখ্যান

রকেটের উচ্চতা: প্রায় ৪০৩ ফুট (১২৩ মিটার)

বুস্টারের ইঞ্জিন সংখ্যা: ৩৩টি র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন

স্টারশিপের ইঞ্জিন সংখ্যা: ৬টি র‍্যাপ্টর ইঞ্জিন

মোট উড়ানের সময়: প্রায় ৬৬ মিনিট

পেলোড: ৮টি স্টারলিংক স্যাটেলাইটের নকল উপগ্রহ

সর্বোচ্চ গতি: প্রায় ২৭,০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা

সর্বোচ্চ উচ্চতা: প্রায় ২১২ কিলোমিটার

উপসংহার: এক নতুন যুগের সূচনা

স্পেসএক্সের স্টারশিপের দশম পরীক্ষামূলক উড়ানের সাফল্য মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা করল। এটি প্রমাণ করে যে বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ এবং নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা মহাকাশ অভিযানের মতো জটিল ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। স্টারশিপের এই সাফল্য আমাদের চাঁদ এবং মঙ্গলে পৌঁছানোর স্বপ্নকে আরও বাস্তব করে তুলেছে এবং মানবজাতিকে এক আন্তঃগ্রহ প্রজাতি (interplanetary species) হিসেবে গড়ে তোলার পথে এক বিশাল পদক্ষেপ। আগামী দিনে স্টারশিপের আরও সফল উড়ান দেখার অপেক্ষায় রইল গোটা বিশ্ব।

About Author