সঠিক স্পোর্টস শু নির্বাচন করা কেবল আরাম বা স্টাইলের ব্যাপার নয়; এটি আপনার পারফর্ম্যান্স এবং স্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। একটি ভুল জুতো আপনার প্রতিদিনের অনুশীলনকে বেদনাদায়ক করে তুলতে পারে, যা থেকে শিন স্প্লিন্ট, প্লান্টার ফ্যাসাইটিস বা এমনকি স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের মতো গুরুতর ইনজুরি হতে পারে। আমেরিকান পোডিয়াট্রিক মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (APMA) প্রায়শই খেলাধুলার সাথে সম্পর্কিত পায়ের আঘাতের জন্য অনুপযুক্ত জুতোকে দায়ী করে। দৌড়ানোর সময়, আপনার পা প্রতি ধাপে আপনার শরীরের ওজনের প্রায় তিন থেকে চার গুণ পর্যন্ত চাপ শোষণ করে। সঠিক কুশনিং এবং সাপোর্ট ছাড়া, এই চাপ সরাসরি আপনার জয়েন্ট এবং হাড়ের উপর পড়ে। তাই, স্পোর্টস শু কেনার আগে আপনার পায়ের ধরণ, আপনি কোন খেলার জন্য জুতো কিনছেন, এবং জুতোর প্রযুক্তিগত দিকগুলো বোঝা অত্যন্ত জরুরি।
এই নিবন্ধে, আমরা স্পোর্টস শু নির্বাচনের প্রতিটি দিক গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব, যাতে আপনি আপনার পরবর্তী কেনাকাটায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমরা পায়ের আর্চ, প্রোনেশন, জুতোর বিভিন্ন অংশ এবং আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনাকে ইনজুরি মুক্ত থাকতে এবং আপনার পারফরম্যান্সকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
কেন সঠিক স্পোর্টস শু নির্বাচন করা এত গুরুত্বপূর্ণ?
আমরা অনেকেই জুতো কেনার সময় এর ডিজাইন বা রঙের উপর বেশি গুরুত্ব দিই। কিন্তু স্পোর্টস শু হলো এক ধরনের প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম (Technical Equipment)। একে শুধু ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে দেখলে চলবে না।
ইনজুরি প্রতিরোধ (Injury Prevention)
সঠিক জুতো আপনার পা-কে সঠিক অ্যালাইনমেন্টে রাখে। এটি অতিরিক্ত চাপ শোষণ করে (Shock Absorption) এবং আপনার পায়ের স্বাভাবিক গতিকে সমর্থন করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভুল জুতো পরার ফলে প্রায় ৬০-৭০% মানুষ পায়ের কোনো না কোনো সমস্যায় ভোগেন। সঠিক জুতো ব্যবহার করলে প্লান্টার ফ্যাসাইটিস (পায়ের তলায় ব্যথা), অ্যাকিলিস টেন্ডিনাইটিস (গোড়ালির পিছনে ব্যথা), এবং শিন স্প্লিন্ট (পায়ের সামনের অংশে ব্যথা) এর মতো সাধারণ ইনজুরিগুলো অনেকাংশে এড়ানো যায়।
পারফর্ম্যান্স বৃদ্ধি (Improved Performance)
আপনি যখন সঠিক জুতো পরেন, তখন আপনার পা কম ক্লান্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাস্কেটবল জুতো আপনাকে দ্রুত দিক পরিবর্তন করতে এবং লাফাতে সাহায্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে রানিং শু আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে সোজা দৌড়াতে সাহায্য করে। ওয়েটলিফটিং জুতো একটি স্থিতিশীল ভিত্তি প্রদান করে, যা আপনাকে ভারোত্তোলনের সময় বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে দেয়। জুতোর ওজন, গ্রিপ এবং রেসপন্সিভনেস (Responsivemess) সরাসরি আপনার পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করে।
দীর্ঘমেয়াদী আরাম ও স্বাস্থ্য (Long-term Comfort & Health)
সঠিক ফিট এবং সাপোর্ট আপনার পা-কে আরাম দেয়। এটি ফোস্কা, কড়া বা নখের সমস্যা প্রতিরোধ করে। দীর্ঘমেয়াদে, ভালো মানের জুতো আপনার হাঁটু, নিতম্ব এবং পিঠের উপর চাপ কমায়, যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে অস্টিওআর্থারাইটিসের মতো সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
কেনার আগে প্রথম ধাপ: আপনার পা-কে জানুন
জুতো কেনার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আপনার নিজের পা সম্পর্কে জানা। প্রতিটি মানুষের পায়ের গঠন আলাদা, এবং আপনার জুতো সেই গঠনের সাথে মানানসই হওয়া উচিত।
পায়ের আর্চ (Arch) বা খিলানের ধরণ বিশ্লেষণ
পায়ের আর্চ হলো আপনার পায়ের তালুর মাঝখানের বাঁকানো অংশ, যা শরীরের ওজন বহনে এবং চাপ শোষণে সাহায্য করে। আপনার আর্চের ধরণ জানতে একটি সহজ “ওয়েট টেস্ট” (Wet Test) করতে পারেন:
- আপনার পা পানিতে ভেজান।
- একটি শুকনো, সমতল পৃষ্ঠে (যেমন কাগজের ব্যাগ বা কংক্রিটের মেঝে) দাঁড়ান।
- সরে এসে আপনার পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করুন।
ফলাফল বিশ্লেষণ:
- নরমাল আর্চ (Normal Arch): আপনি যদি আপনার হিল এবং পায়ের সামনের অংশের মধ্যে একটি স্পষ্ট বাঁক দেখতে পান, যা পায়ের ছাপের প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে, তবে আপনার নরমাল আর্চ। এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং কার্যকরী পায়ের ধরণ।
- ফ্ল্যাট ফিট বা চ্যাপ্টা পা (Flat Feet): যদি আপনার পায়ের ছাপটি প্রায় সম্পূর্ণ পায়ের তালুর মতো দেখায় (খুব কম বা কোনো বাঁক নেই), তবে আপনার পা চ্যাপ্টা বা ‘ফ্ল্যাট ফিট’।
- হাই আর্চ (High Arch): যদি আপনার ছাপে কেবল হিল এবং পায়ের আঙ্গুলের নিচের অংশ দেখা যায়, এবং মাঝখানে খুব সরু একটি সংযোগ থাকে বা কোনো সংযোগই না থাকে, তবে আপনার ‘হাই আর্চ’।
প্রোনেশন (Pronation): আপনার হাঁটার ধরণ
প্রোনেশন হলো হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় আপনার পা মাতিতে পড়ার পর স্বাভাবিকভাবে ভেতরের দিকে গড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। এটি শরীরের প্রাকৃতিক শক শোষক হিসেবে কাজ করে। আপনার আর্চের ধরণের সাথে প্রোনেশন সরাসরি সম্পর্কিত।
- নিউট্রাল প্রোনেশন (Neutral Pronation):
- কী ঘটে: পা মাতিতে পড়ার পর স্বাভাবিক এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে ভেতরের দিকে রোল করে। এটি কার্যকরভাবে চাপ শোষণ করে।
- কাদের হয়: সাধারণত নরমাল আর্চ যাদের, তাদের নিউট্রাল প্রোনেশন হয়।
- কোন জুতো প্রয়োজন: আপনার ‘নিউট্রাল’ (Neutral) বা ‘কুশনিং’ (Cushioning) জুতো প্রয়োজন, যা ভালো শক শোষণ এবং মাঝারি সাপোর্ট প্রদান করে।
- ওভারপ্রোনেশন (Overpronation):
- কী ঘটে: পা মাতিতে পড়ার পর অতিরিক্ত বা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভেতরের দিকে গড়িয়ে যায়। এটি গোড়ালি এবং হাঁটুর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
- কাদের হয়: এটি সাধারণত ফ্ল্যাট ফিট বা চ্যাপ্টা পায়ের অধিকারীদের মধ্যে দেখা যায়।
- কোন জুতো প্রয়োজন: আপনার ‘স্টেবিলিটি’ (Stability) বা ‘মোশন কন্ট্রোল’ (Motion Control) জুতো প্রয়োজন। এই জুতাগুলোতে মিডসোলের ভেতরের দিকে শক্ত ফোম (যাকে ‘মিডিয়াল পোস্ট’ বলা হয়) থাকে, যা পা-কে অতিরিক্ত গড়িয়ে যাওয়া থেকে বাধা দেয়।
- আন্ডারপ্রোনেশন বা সুপিনেশন (Underpronation/Supination):
- কী ঘটে: পা মাতিতে পড়ার পর ভেতরের দিকে না গড়িয়ে বরং বাইরের দিকে রোল করে। এর ফলে পায়ের বাইরের অংশে এবং হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, কারণ পা ঠিকমতো শক শোষণ করতে পারে না।
- কাদের হয়: এটি সাধারণত হাই আর্চ (High Arch) থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়।
- কোন জুতো প্রয়োজন: আপনার ‘কুশনিং’ (Cushioning) বা ‘নিউট্রাল’ জুতো প্রয়োজন, যাতে প্রচুর শক শোষণের ক্ষমতা থাকে। এই জুতাগুলো সাধারণত খুব নমনীয় হয় এবং কোনো অতিরিক্ত স্টেবিলিটি সাপোর্ট থাকে না।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: আমেরিকান কলেজ অফ স্পোর্টস মেডিসিন (ACSM) সুপারিশ করে যে, দৌড়বিদদের তাদের প্রোনেশনের ধরণ বোঝার জন্য বিশেষায়িত রানিং স্টোরে গিয়ে ‘গেইট অ্যানালিসিস’ (Gait Analysis) করানো উচিত।
স্পোর্টস শু-এর অ্যানাটমি: জুতোর কোন অংশের কী কাজ?
একটি স্পোর্টস শু-কে ভালোভাবে বুঝতে হলে এর প্রধান অংশগুলো সম্পর্কে জানা দরকার।
আপার (Upper)
এটি জুতোর উপরের অংশ যা আপনার পা-কে ঢেকে রাখে।
- উপাদান:
- মেশ (Mesh): এটি সবচেয়ে সাধারণ। এটি হালকা, নিঃশ্বাসযোগ্য (Breathable) এবং নমনীয়। রানিং বা ট্রেনিং এর জন্য আদর্শ।
- নিট (Knit): (যেমন Nike Flyknit বা Adidas Primeknit) এটি মোজার মতো ফিটিং দেয়, খুব আরামদায়ক এবং হালকা।
- সিনথেটিক লেদার/লেদার (Synthetic Leather/Leather): এটি বেশি টেকসই এবং সাপোর্ট প্রদান করে। বাস্কেটবল, টেনিস বা হাইকিং জুতোতে এটি বেশি দেখা যায়।
- গোর-টেক্স (Gore-Tex): এটি একটি ওয়াটারপ্রুফ (জলরোধী) কিন্তু নিঃশ্বাসযোগ্য মেমব্রেন, যা ট্রেইল রানিং বা হাইকিং শু-তে ব্যবহৃত হয়।
মিড-সোল (Midsole): জুতোর ‘ইঞ্জিন’
মিড-সোল হলো জুতোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আউটসোল (বাইরের সোল) এবং ইনসোলের (ভেতরের সোল) মধ্যে থাকে। এটি কুশনিং এবং স্টেবিলিটি প্রদান করে।
- ফোম টেকনোলজি:
- EVA (Ethylene-Vinyl Acetate): এটি একটি হালকা এবং নরম ফোম। বেশিরভাগ রানিং শু-তে এটি বেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এটি সময়ের সাথে সাথে সংকুচিত (Compress) হয়ে যেতে পারে।
- PU (Polyurethane): এটি EVA-এর চেয়ে ঘন, ভারী এবং বেশি টেকসই। এটি ভালো কুশনিং ধরে রাখে।
- ব্র্যান্ডেড টেকনোলজি:
- ASICS GEL: এটি মিডসোলের হিল এবং ফোরফুটে সিলিকন-ভিত্তিক জেল প্যাড ব্যবহার করে, যা চমৎকার শক শোষণ প্রদান করে।
- Adidas Boost: এটি হাজার হাজার TPU (Thermoplastic Polyurethane) পেলেটের সমন্বয়ে গঠিত। এটি অত্যন্ত রেসপন্সিভ (শক্তি ফেরত দেয়) এবং টেকসই।
- Nike Air/ZoomX: Nike Air কুশনিংয়ের জন্য সংকুচিত বায়ু পকেট ব্যবহার করে। ZoomX হলো তাদের সবচেয়ে হালকা এবং রেসপন্সিভ ফোম, যা ম্যারাথন জুতোতে ব্যবহৃত হয়।
- Saucony PWRRUN: এটি EVA-ভিত্তিক একটি আধুনিক ফোম যা কুশনিং এবং রেসপন্সিভনেসের ভালো ভারসাম্য প্রদান করে।
আউট-সোল (Outsole)
এটি জুতোর একেবারে নিচের অংশ যা মাটির সাথে সরাসরি স্পর্শে থাকে। এর প্রধান কাজ হলো গ্রিপ (Grip) এবং স্থায়িত্ব (Durability) প্রদান করা।
- কার্বন রাবার (Carbon Rubber): খুব টেকসই, সাধারণত রানিং শু-এর হিল অংশে ব্যবহৃত হয়।
- ব্লোন রাবার (Blown Rubber): এটি হালকা, নরম এবং বেশি গ্রিপি। সাধারণত রানিং শু-এর সামনের অংশে ব্যবহৃত হয়।
- গাম রাবার (Gum Rubber): ইনডোর কোর্ট (ব্যাডমিন্টন, ভলিবল) জুতোতে ব্যবহৃত হয়, যা চমৎকার গ্রিপ দেয় এবং ফ্লোরে দাগ ফেলে না।
ইন-সোল (Insole) / সকলাইনার (Sockliner)
এটি জুতোর ভেতরে থাকা সরু, নরম প্যাড যা আপনি বের করতে পারেন। এটি প্রাথমিক আরাম এবং আর্চ সাপোর্ট প্রদান করে। অনেকে ভালো সাপোর্টের জন্য আলাদাভাবে ‘অর্থোটিক’ (Orthotic) ইনসোল কিনে ব্যবহার করেন।
বর্ষায় পোষ্যের পায়ের অযত্ন নানা রোগের কারণ হতে পারে: জানুন সঠিক যত্নের উপায়
হিল কাউন্টার (Heel Counter)
এটি জুতোর পেছনের শক্ত অংশ যা আপনার গোড়ালিকে স্থির রাখে। একটি শক্ত হিল কাউন্টার ওভারপ্রোনেশন কমাতে সাহায্য করে।
হিল-টু-টো ড্রপ (Heel-to-Toe Drop)
এটি জুতোর হিল (গোড়ালি) এবং টো (পায়ের আঙ্গুল) এর উচ্চতার পার্থক্য, যা মিলিমিটারে (mm) মাপা হয়।
- ঐতিহ্যবাহী (Traditional) (৮-১২ মিমি): বেশিরভাগ রানিং শু এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। এটি হিল স্ট্রাইকারদের (যারা দৌড়ানোর সময় প্রথমে গোড়ালি ফেলেন) জন্য ভালো।
- লো ড্রপ (Low Drop) (৪-৬ মিমি): এটি পা-কে মাটির কাছাকাছি রাখে এবং মিডফুট স্ট্রাইকিং (মাঝামাঝি পা ফেলা) উৎসাহিত করে।
- জিরো ড্রপ (Zero Drop) (০ মিমি): (যেমন Altra বা Vibram FiveFingers ব্র্যান্ড) এটি পায়ের প্রাকৃতিক অবস্থান বজায় রাখে, যেন আপনি খালি পায়ে দৌড়াচ্ছেন। এটিতে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে।
বিভিন্ন খেলাধুলা, বিভিন্ন জুতো
সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘এক জুতো সব কাজে’ (One-Shoe-Fits-All) মানসিকতা। প্রতিটি খেলা পায়ের উপর ভিন্ন ভিন্ন চাপ সৃষ্টি করে, তাই জুতোও ভিন্নভাবে ডিজাইন করা হয়।
রানিং শু (Running Shoes)
- উদ্দেশ্য: সোজা লাইনে দৌড়ানো, শক শোষণ করা।
- বৈশিষ্ট্য: চমৎকার কুশনিং (বিশেষ করে হিলে), নমনীয় ফোরফুট (পায়ের আঙ্গুল বাঁকানোর জন্য), এবং নিঃশ্বাসযোগ্য আপার।
- প্রকারভেদ:
- রোড রানিং (Road Running): মসৃণ রাস্তার জন্য ডিজাইন করা, হালকা এবং ভালো কুশনিংযুক্ত।
- ট্রেইল রানিং (Trail Running): মাটির রাস্তা, পাথর বা অসমতলের জন্য। এর আউটসোলে গভীর ট্রেড বা গ্রিপ থাকে, এটি বেশি টেকসই এবং পা-কে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শক্ত উপাদান দিয়ে তৈরি।
জিম এবং ট্রেনিং শু (Gym & Training Shoes)
- উদ্দেশ্য: বিভিন্ন ধরনের নড়াচড়া (পাশে যাওয়া, লাফানো, ভারোত্তোলন)।
- বৈশিষ্ট্য:
- ক্রস-ট্রেইনার (Cross-Trainers): এগুলোর বেস চওড়া এবং স্থিতিশীল হয়। রানিং শু-এর মতো নরম নয়, কারণ হাই-ইমপ্যাক্ট অ্যারোবিক্স বা প্লায়োমেট্রিক্সের জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।
- ওয়েটলিফটিং শু (Weightlifting Shoes): এই জুতাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে শক্ত এবং সমতল সোল (Flat Sole) দিয়ে তৈরি হয়। এর হিল সামান্য উঁচু থাকে (Heel Lift), যা স্কোয়াট (Squat) করার সময় ভালো ভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করে। গুরুত্বপূর্ণ: রানিং শু পরে ওয়েটলিফটিং করা উচিত নয়, কারণ নরম কুশনিং একটি অস্থিতিশীল ভিত্তি তৈরি করে।
কোর্ট শু (Court Shoes)
- উদ্দেশ্য: দ্রুত দিক পরিবর্তন, পাশে নড়াচড়া (Lateral Movement), এবং থামা।
- প্রকারভেদ:
- টেনিস শু (Tennis Shoes): রানিং শু সোজা দৌড়ানোর জন্য, কিন্তু টেনিস শু পাশে দৌড়ানোর জন্য ডিজাইন করা। এর আউটসোল খুব টেকসই এবং আপার অংশ পা-কে পাশে সরে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
- বাস্কেটবল শু (Basketball Shoes): হাই-টপ (High-top) ডিজাইন গোড়ালিকে (Ankle) সাপোর্ট দেয়। জাম্পিং-এর জন্য প্রচুর কুশনিং থাকে এবং ইনডোর কোর্টের জন্য বিশেষ গ্রিপ থাকে।
- ব্যাডমিন্টন/ভলিবল শু (Badminton/Volleyball Shoes): এগুলোর গাম রাবার (Gum Rubber) আউটসোল থাকে, যা কাঠের ফ্লোরে দুর্দান্ত গ্রিপ দেয়। এগুলি খুব হালকা হয়।
বালেনসিয়াগার ‘জিরো শু’ এর আশ্চর্যজনক ৪০,০০০ টাকার মূল্যটেগ
ফিল্ড শু (Field Shoes)
- উদ্দেশ্য: ঘাস বা নরম মাটিতে খেলা।
- বৈশিষ্ট্য: আউটসোলে ক্লিট (Cleats) বা স্পাইক (Spikes) থাকে।
- ফুটবল বুট (Football Boots): মাটির ধরণ (Firm Ground, Soft Ground) অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লিট প্যাটার্ন থাকে।
- ক্রিকেট শু (Cricket Shoes): বোলারদের জন্য স্পাইক থাকে (রান-আপে গ্রিপের জন্য), এবং ব্যাটসম্যানরা রাবার স্টাড ব্যবহার করতে পারেন।
কখন এবং কীভাবে জুতো কিনবেন?
সঠিক জুতো নির্বাচন করার পাশাপাশি, এটি সঠিকভাবে কেনাও একটি শিল্প।
কেনার সেরা সময়: বিকাল বা সন্ধ্যা
বিশেষজ্ঞরা, যেমন আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ অর্থোপেডিক সার্জনস (AAOS), পরামর্শ দেন যে জুতো কেনার সেরা সময় হলো দিনের শেষে বা আপনার ওয়ার্কআউটের পরে। এর কারণ হলো সারাদিনের কার্যকলাপে আপনার পা স্বাভাবিকভাবে কিছুটা ফুলে যায় (Swell)। সকালে কেনা জুতো বিকালে টাইট লাগতে পারে।
সঠিক মাপ (The Right Size)
একটি বহুল প্রচলিত ভুল হলো পুরোনো মাপের উপর নির্ভর করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা ওজন পরিবর্তনের সাথে পায়ের আকার পরিবর্তিত হতে পারে।
- দুটি পা-ই মাপুন: বেশিরভাগ মানুষের একটি পা অন্যটির চেয়ে সামান্য বড় হয়। সবসময় বড় পা-টির মাপ অনুযায়ী জুতো কিনুন।
- থাম্ব রুল (Thumb’s Rule): জুতোর সামনে আপনার সবচেয়ে লম্বা আঙ্গুল (সাধারণত বুড়ো আঙ্গুল বা দ্বিতীয় আঙ্গুল) এবং জুতোর শেষের মধ্যে অন্তত আধা ইঞ্চি বা আপনার বুড়ো আঙ্গুলের প্রস্থের সমান জায়গা থাকা উচিত।
- টো বক্স (Toe Box): নিশ্চিত করুন যে আপনার পায়ের আঙ্গুলগুলো জুতোর ভেতরে স্বাচ্ছন্দ্যে নাড়াচাড়া করতে পারে (Wiggle Room)। এটি খুব চাপা হওয়া উচিত নয়।
- ব্র্যান্ডের ভিন্নতা: মনে রাখবেন, সব ব্র্যান্ডের সাইজিং এক নয়। Nike-এর ১০ নম্বর সাইজ হয়তো Adidas বা ASICS-এর ১০ নম্বর সাইজের সমান নাও হতে পারে। সবসময় ট্রাই করে দেখুন।
মোজা (Socks)
জুতো ট্রাই করার সময় আপনি যে ধরনের মোজা পরে খেলাধুলা করেন, ঠিক সেই ধরনের মোজা (বা একই রকম পুরু) পরে নিন। সুতির মোজা এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো ঘাম ধরে রাখে এবং ফোস্কা সৃষ্টি করতে পারে। সিনথেটিক বা উলের স্পোর্টস সকস ব্যবহার করুন।
‘ব্রেক-ইন’ (Break-in) পিরিয়ড
আধুনিক স্পোর্টস শু-তে সাধারণত দীর্ঘ ‘ব্রেক-ইন’ পিরিয়ডের প্রয়োজন হয় না। একটি ভালো জুতো দোকান থেকেই আরামদায়ক লাগা উচিত। তবে, নতুন জুতো পরে সরাসরি কোনো বড় প্রতিযোগিতা বা লম্বা দৌড়ে অংশ নেবেন না। প্রথমে এটি পরে কিছুক্ষণ হাঁটুন বা ছোটখাটো ওয়ার্কআউট করুন।
সাধারণ ভুলগুলো যা এড়িয়ে চলবেন
- ১. ডিজাইনকে প্রাধান্য দেওয়া: জুতোটি দেখতে সুন্দর কিন্তু আপনার পায়ের ধরণের সাথে মানানসই নয়, এমন জুতো কেনা সবচেয়ে বড় ভুল।
- ২. ভুল মাপের জুতো পরা: দ্য কলেজ অফ পোডিয়াট্রি (ইউকে)-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুরুষ এবং প্রায় অর্ধেক মহিলা স্বীকার করেছেন যে তারা এমন জুতো কেনেন যা তাদের ঠিকমতো ফিট হয় না। খুব টাইট জুতো কড়া, নখের সমস্যা এবং নার্ভের ক্ষতি করতে পারে।
- ৩. জুতো প্রতিস্থাপনে দেরি করা: একটি স্পোর্টস শু চিরকাল চলে না। এর মিডসোল সময়ের সাথে সাথে কুশনিং ক্ষমতা হারায়, এমনকি বাইরে থেকে দেখতে নতুনের মতো হলেও।
- ৪. এক জুতো সব কাজে ব্যবহার: রানিং শু পরে টেনিস খেললে আপনি দ্রুত জুতোটি নষ্ট করে ফেলবেন এবং ইনজুরির ঝুঁকিতে পড়বেন।
পায়ের প্লাস্টার খোলার সহজ উপায় – যা আপনার জানা প্রয়োজন
কখন আপনার জুতো প্রতিস্থাপন করবেন?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জুতো প্রতিস্থাপনের সময় নির্ভর করে আপনি কতটা ব্যবহার করেন, আপনার ওজন, আপনার দৌড়ানোর ধরণ এবং আপনি কোন পৃষ্ঠে দৌড়ান তার উপর।
- রানিং শু: বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ, যেমন Runner’s World ম্যাগাজিন, প্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার (প্রায় ৩০০-৫০০ মাইল) দৌড়ানোর পর জুতো পরিবর্তন করার পরামর্শ দেয়।
- কোর্ট বা জিম শু: এগুলো মাইলেজ দিয়ে মাপা কঠিন। সাধারণত প্রতি ৬ মাস থেকে ১ বছর নিয়মিত ব্যবহারের পর পরিবর্তন করা উচিত, বা যখন আপনি সাপোর্ট কমে গেছে বলে অনুভব করেন।
- আউটসোল: আউটসোলের ট্রেড সম্পূর্ণ মসৃণ হয়ে গেছে।
- মিডসোল: মিডসোলে ভাঁজ বা ক্র্যাক দেখা যাচ্ছে। আপনি যদি ফোমটি টিপেন এবং এটি আর আগের মতো বাউন্স ব্যাক না করে, তবে এর কুশনিং নষ্ট হয়ে গেছে।
- অস্বাভাবিক ব্যথা: আপনি যদি হঠাৎ করে হাঁটু, গোড়ালি বা পায়ে নতুন কোনো ব্যথা অনুভব করেন, তবে এটি জুতোর সাপোর্ট নষ্ট হয়ে যাওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
স্পোর্টস শু মার্কেট: কিছু তথ্য ও প্রবণতা
সঠিক জুতো কেনার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী বাড়ছে।
- বাজারের আকার: গ্লোবাল অ্যাথলেটিক ফুটওয়্যার মার্কেট ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ (Grand View Research)-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালে এই বাজারের আকার ছিল প্রায় ১৩০.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এটি ২০২৪ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪.৮% চক্রবৃদ্ধি হারে (CAGR) বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
- টেকনোলজির প্রভাব: কোম্পানিগুলো ক্রমাগত নতুন নতুন টেকনোলজি (যেমন কার্বন প্লেট, স্মার্ট শু যাতে সেন্সর আছে, থ্রিডি-প্রিন্টেড মিডসোল) নিয়ে আসছে।
- সাসটেইনেবিলিটি (Sustainability): বর্তমানে গ্রাহকরা পরিবেশ-সচেতন হচ্ছেন। তাই অ্যাডিডাসের প্রাইমব্লু (Parley Ocean Plastic) বা নাইকির ‘মুভ টু জিরো’ (Move to Zero) উদ্যোগের মতো পুনর্ব্যবহারযোগ্য (Recycled) উপকরণ দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
আপনার স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করুন
একটি স্পোর্টস শু কেনা একটি জটিল সিদ্ধান্ত হতে পারে, তবে এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য একটি অপরিহার্য বিনিয়োগ। এটি কেবল একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট নয়, এটি আপনার পা, হাঁটু এবং পিঠকে রক্ষা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। পরের বার জুতো কিনতে যাওয়ার আগে, সময় নিন। আপনার পায়ের ধরণ জানুন (আর্চ এবং প্রোনেশন), আপনি কোন খেলার জন্য জুতো কিনছেন তা নির্দিষ্ট করুন এবং বিভিন্ন জুতো ট্রাই করে দেখুন। মনে রাখবেন, সবচেয়ে দামি জুতোর চেয়ে আপনার জন্য ‘সঠিক’ জুতোটিই সেরা।











