ফের শিরোনামে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। আসানসোল বিশেষ সংশোধনাগারে বন্দি থাকাকালীন পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠল তাঁর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, মাসখানেক আগে তাঁর বাড়ির পুকুর থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন থেকেই এখন একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে বলে দাবি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি-র। এই দুই জোড়া ফলার যুক্তিতেই জীবনকে ফের নিজেদের হেফাজতে নিতে আদালতে আবেদন জানায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই আবেদন মঞ্জুর করে আদালত জীবনকৃষ্ণকে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। এই ঘটনায় নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নতুন মোড় আসতে চলেছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে ইডি দাবি করে, জীবনকৃষ্ণ সাহা একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের একাধিক চেষ্টা করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি আসানসোল জেলে বন্দি থাকাকালীন তিনি পাঁচিল টপকে হওয়ার চেষ্টা করেন, যা তাঁর মরিয়া মনোভাবের পরিচয় দেয়। জেলের নিরাপত্তা রক্ষীদের তৎপরতায় সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইডির আইনজীবী আদালতে সওয়াল করেন, যে ব্যক্তি তদন্তের শুরু থেকেই প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টা করছেন এবং জেল থেকে পালানোর ছক কষছেন, তাঁকে কোনোভাবেই বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব নয়। তাঁর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করতে হলে তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করা অপরিহার্য।
তদন্তকারী সংস্থার তরফে আদালতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়। নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের তদন্তে নেমে সিবিআই যখন প্রথমবার জীবনের মুর্শিদাবাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল, তখন তিনি প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে নিজের দুটি মোবাইল ফোন বাড়ির পাশের পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ চেষ্টার পর সেই ফোন দুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। ইডির দাবি, সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর পর সেই দুটি ফোন থেকে বহু মুছে ফেলা তথ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তদন্তকারীরা নিয়োগ দুর্নীতি চক্রের আরও গভীরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। ইডির দাবি, উদ্ধার হওয়া তথ্যে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম, চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা এবং কোটি কোটি টাকার লেনদেনের হিসেব রয়েছে। এই সমস্ত তথ্য সামনে রেখে জীবনকে জেরা করা প্রয়োজন।
ইডি আদালতে জানায়, উদ্ধার হওয়া মোবাইল ডেটা থেকে জানা গিয়েছে যে, জীবনকৃষ্ণ সাহা কেবলমাত্র একজন মধ্যস্থতাকারী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন নিয়োগ দুর্নীতি চক্রের অন্যতম প্রধান মাথা। তাঁর ফোনে এমন কিছু চ্যাট এবং ভয়েস নোট পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে স্পষ্ট যে তিনি সরাসরি চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলে প্রভাবশালী মহলে পৌঁছে দিতেন। কোন চাকরিপ্রার্থীর জন্য কত টাকা নেওয়া হবে, সেই টাকা কাদের মধ্যে ভাগ হবে এবং কীভাবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি হবে—এই সবকিছুরই ব্লুপ্রিন্ট ছিল জীবনের ফোনে। এই তথ্যপ্রমাণ হাতে আসার পরেই ইডি তাঁকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য তৎপর হয়। পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টা সেই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রায় ৬৫ ঘণ্টা ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদের পর সিবিআই জীবনকৃষ্ণ সাহাকে তাঁর বড়ঞার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছিল। সিবিআই অভিযানের শুরুতেই জীবন তদন্তকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পুকুরে নিজের দুটি ফোন ফেলে দেন। এরপরই পুকুরের জল ছেঁচে প্রায় ৩২ ঘণ্টার চেষ্টায় উদ্ধার করা হয় সেই ফোন দুটি। সেই সময় থেকেই তদন্তকারীরা মনে করছিলেন, এই ফোন দুটিই হতে পারে নিয়োগ দুর্নীতির ‘তথ্যভান্ডার’। অবশেষে সেই অনুমানই সত্যি প্রমাণিত হলো। ফরেনসিক রিপোর্টে উঠে আসা তথ্যগুলি এতটাই বিস্ফোরক যে, তা মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এর আগে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য, এসএসসি-র প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহার মতো একাধিক হেভিওয়েট নেতা ও আধিকারিক গ্রেফতার হয়েছেন। জীবনকৃষ্ণের গ্রেফতারি সেই তালিকাকে আরও দীর্ঘায়িত করে। তদন্তকারীদের মতে, জীবন মূলত মুর্শিদাবাদ এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে নিয়োগ দুর্নীতির নেটওয়ার্ক চালাতেন। তাঁর কাজ ছিল টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া। তাঁর মোবাইল থেকে পাওয়া তথ্য শুধুমাত্র তাঁর নিজের অপরাধই প্রমাণ করবে না, বরং এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আরও অনেক ‘বড় মাথা’-র নাম সামনে আনবে বলে আশা করছে ইডি।
আদালতে ইডির জোরালো সওয়ালের পর বিচারক জীবনকৃষ্ণ সাহাকে ১৪ দিনের জন্য ইডি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, এই ১৪ দিনে জীবনের মুখোমুখি বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ পেশ করা হবে। বিশেষ করে, তাঁর ফোন থেকে উদ্ধার হওয়া চ্যাট, ছবি এবং আর্থিক লেনদেনের নথি দেখিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হবে। তাঁর সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত, টাকার ভাগ কে কে পেতেন এবং কীভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতো—এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এখন মরিয়া ইডি। পুকুরে ছুড়ে ফেলা সেই মোবাইল ফোনই এখন জীবনকৃষ্ণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তকে এক নতুন দিশা দেখাচ্ছে।