SSC কেলেঙ্কারিতে ‘হাজারো প্রাণ ধ্বংস’ করে এখন ‘দাগি’দের সুরক্ষার চেষ্টা! সুপ্রিম কোর্টে তীব্র তিরস্কার রাজ্যের

পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) কেলেঙ্কারির নতুন মাত্রায় সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে। গত আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং সতীশ চন্দ্র শর্মার বিভাগীয় বেঞ্চ…

Avatar

 

পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) কেলেঙ্কারির নতুন মাত্রায় সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে। গত আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং সতীশ চন্দ্র শর্মার বিভাগীয় বেঞ্চ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করে বলেছেন, “আপনারা হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও প্রার্থীর জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছেন। এখন যদি আপনারা সেই দাগি প্রার্থীদের আবার পরীক্ষায় বসতে দেন, তাহলে আমরা আপনাদের উপর পাহাড়ের মতো নেমে আসব।”

এই কঠোর মন্তব্যের পেছনে রয়েছে ২০১৬ সালের রাষ্ট্রীয় স্তরের নির্বাচন পরীক্ষায় (SLST) ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ। সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে প্রায় ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীর চাকরি বাতিল করেছে, যার মধ্যে ১,৮০৪ জনকে ‘দাগি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়াটি জালিয়াতি ও কারচুপিতে কলুষিত হয়ে পড়েছিল।

বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এক শুনানিতে স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, “এটা খুবই হতাশাজনক যে আপনারা যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। আপনারা এখনও আপনাদের পছন্দের অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরিতে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন? এটা লজ্জাজনক!”

সুপ্রিম কোর্টের এই তিরস্কারের মূল কারণ হচ্ছে ২০১৬ সালের নিয়োগ পরীক্ষায় যে ভয়াবহ অনিয়ম ঘটেছিল তার ব্যাপকতা। CBI-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, OMR সিটে কারচুপি, র‍্যাঙ্ক জাম্পিং, প্যানেল থেকে বাইরের প্রার্থীদের নিয়োগ এবং এমনকি খালি OMR সিট জমা দেওয়া প্রার্থীদেরও চাকরি দেওয়া হয়েছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশন নিজেই স্বীকার করেছে যে অন্তত ৬,২৭৬টি অবৈধ নিয়োগ হয়েছে।

অবশেষে প্রকাশ পেল ১ হাজার ৮০৪ জন দাগি প্রার্থী তালিকা, সবার চোখ এখন স্কুল সার্ভিস কমিশনে

ঢাকের মতো সব অনিয়মের পর এখন রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশন চেষ্টা করছিল ‘দাগি’ প্রার্থীদের নতুন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে। এই প্রচেষ্টায় সুপ্রিম কোর্ট ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছে, “যদি আপনারা দাগি প্রার্থীদের তালিকায় থাকা কোনো প্রার্থীকে আবার নির্বাচিত হতে দেন, তাহলে আপনারা আমাদের রোষের সম্মুখীন হবেন।”

গত ৩০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন ১,৮০৪ জন দাগি প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় থাকা প্রার্থীরা ভবিষ্যতে কোনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তালিকায় রয়েছে সেইসব প্রার্থীরা যারা OMR সিটে কারচুপি করেছেন অথবা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে চাকরি পেয়েছেন।

কলকাতা হাইকোর্ট তার এপ্রিল ২০২৪ সালের রায়ে বলেছিল যে “সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া এমন রহস্য এবং স্তরে আবৃত ছিল যে সেখানে সংঘটিত অবৈধতার পরিমাণ অনুমান করা কঠিন ছিল।” হাইকোর্ট উল্লেখ করেছিল যে জালিয়াতি “গভীর এবং ব্যাপক” এবং নিয়মিত ও অনিয়মিতদের আলাদা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

এই কেলেঙ্কারির শিকড় গভীরে প্রোথিত। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন বিধায়ক এই কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ২১ কোটি টাকা নগদ এবং ১ কোটি টাকার বেশি মূল্যের গহনা উদ্ধার হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্ট এই পুরো ঘটনাকে “প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি” আখ্যা দিয়েছে এবং বলেছে যে “বড় পরিসরে কারচুপি ও জালিয়াতি, সাথে ধামাচাপার প্রচেষ্টা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে মেরামতের অযোগ্য করে তুলেছে।” কোর্ট স্পষ্ট করেছে যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ও বৈধতা সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।

বর্তমানে নতুন নিয়োগ পরীক্ষা ৭ ও ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু যেসব শিক্ষক ‘দাগি’ নন তাদের একদিকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে পড়ানোর দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, অন্যদিকে নতুন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে রাজ্য সরকার চাইলে পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দিতে পারে।

রাজ্য সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করলেও সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে। কোর্ট বলেছে যে “নির্বাচন প্রক্রিয়ার পবিত্রতা রক্ষা করা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং এটিকে সকল ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে।”

শিক্ষক আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ ও তৃণমূল বাহিনীর বর্বরতা

এই পুরো ঘটনা শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। সৎ ও মেধাবী প্রার্থীদের পাশাপাশি হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে এই কেলেঙ্কারির কারণে। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে এমন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা কঠোর হবে এবং কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না।

কলকাতা হাইকোর্ট এই ‘দাগি’ প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ করা পিটিশনগুলি খারিজ করে দিয়ে বলেছে “সবকিছুর একটা সীমা আছে”। বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন যে পরীক্ষার ঠিক আগে এসে এই ধরনের আবেদন “অভিন্নতা নষ্ট করার” চেষ্টা।

এই কেলেঙ্কারি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিতে আঘাত হেনেছে এবং সুপ্রিম কোর্টের কঠোর অবস্থান দেখিয়েছে যে ন্যায়বিচারের জন্য কোনো সমঝোতা গ্রহণযোগ্য নয়। এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হাজার হাজার শিক্ষাপ্রার্থীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এবং পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম