ইলন মাস্কের বিখ্যাত কোম্পানি স্পেসএক্স-এর স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট পরিষেবা শীঘ্রই ভারতে পৌঁছতে চলেছে। এই স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতের টেলিকম বাজারে এটি একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এর দাম, গতি এবং চালু হওয়ার সময় নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা স্টারলিঙ্কের ভারতে আগমনের সম্ভাব্য দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
স্টারলিঙ্ক হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit বা LEO) হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়। ভারতে এটি চালু হলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ, যারা এখনো ঐতিহ্যবাহী ব্রডব্যান্ড বা ফাইবার সংযোগ থেকে বঞ্চিত, তারা উপকৃত হতে পারেন। সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা এই পরিষেবাটির দাম প্রথম বছরে প্রায় ১,৫৮,০০০ টাকা এবং দ্বিতীয় বছর থেকে ১,১৫,০০০ টাকা হতে পারে বলে জানা গেছে। গতির ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ২২০ মেগাবিট প্রতি সেকেন্ড (Mbps) পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে, যা অনলাইন গেমিং, ভিডিও কল এবং স্ট্রিমিংয়ের জন্য উপযুক্ত। তবে চূড়ান্ত দাম ও পরিষেবার বিস্তারিত এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
এই প্রকল্পের পেছনে স্পেসএক্সের উদ্দেশ্য হলো বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া। ভারতের মতো একটি বৈচিত্র্যময় দেশে, যেখানে শহরগুলোতে ফাইবার ইন্টারনেট থাকলেও গ্রামে সংযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, স্টারলিঙ্ক একটি সমাধান হতে পারে। ২০২২ সালে স্টারলিঙ্ক ভারতে ‘গ্লোবাল মোবাইল পার্সোনাল কমিউনিকেশন বাই স্যাটেলাইট’ (GMPCS) লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। সাম্প্রতিক খবরে জানা গেছে, ভারত সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পথে তারা এগিয়ে চলেছে। রিলায়েন্স জিও এবং ভারতী এয়ারটেলের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই পরিষেবা আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে নিয়ন্ত্রক সংক্রান্ত কিছু জটিলতা এখনো বাকি, যা সমাধানের পরই চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করা সম্ভব হবে।
ভারতে স্টারলিঙ্কের দাম নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ রয়েছে। সূত্র অনুযায়ী, ব্যবহারকারীদের একটি স্টারলিঙ্ক কিট কিনতে হবে, যার মূল্য প্রায় ৩৭,৪০০ টাকা হতে পারে। এর সঙ্গে মাসিক পরিষেবা খরচ যোগ হবে ৭,৪২৫ টাকা। এই দাম শহরাঞ্চলের সাধারণ ফাইবার ইন্টারনেটের তুলনায় অনেক বেশি, যেখানে জিও বা এয়ারটেলের প্ল্যান ৩৯৯ টাকা থেকে শুরু হয়। তবে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে ইন্টারনেটের বিকল্প সীমিত, সেখানে এই দাম গ্রহণযোগ্য হতে পারে। স্টারলিঙ্কের লক্ষ্য শহরের চেয়ে বেশি দুর্গম স্থানে পরিষেবা দেওয়া, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যবসার জন্য ইন্টারনেট অত্যন্ত প্রয়োজন।
গতির দিক থেকে স্টারলিঙ্ক অনেকটাই আশা জাগায়। এটি ২৫ থেকে ২২০ Mbps পর্যন্ত গতি দিতে পারে, যা ঐতিহ্যবাহী স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের তুলনায় অনেক ভালো। সাধারণ স্যাটেলাইট ইন্টারনেটে লেটেন্সি (বিলম্ব) ৬০০ মিলিসেকেন্ডের বেশি হয়, যা ভিডিও কল বা গেমিংয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু স্টারলিঙ্কের লেটেন্সি মাত্র ২৫ থেকে ৫০ মিলিসেকেন্ড, কারণ এর স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। এই প্রযুক্তি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্পেসএক্স ইতিমধ্যে ৭,০০০-এর বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করছে।
চালু হওয়ার সময় নিয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ভারত সরকারের টেলিকম বিভাগ (DoT) এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের উপর এটি নির্ভর করছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে জানা গিয়েছিল যে, স্টারলিঙ্ক শেয়ারহোল্ডিং প্যাটার্ন স্পষ্ট করার পর সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পেতে পারে। সরকারের শর্ত অনুযায়ী, ব্যবহারকারীর তথ্য ভারতেই সংরক্ষণ করতে হবে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। এই শর্তগুলো মানলে ২০২৫ সালের মধ্যে স্টারলিঙ্ক ভারতে বাণিজ্যিকভাবে চালু হতে পারে। তবে আবহাওয়ার প্রভাব, যেমন ভারী বৃষ্টি বা মেঘলা আকাশ, এর সংযোগে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এই পরিষেবার প্রভাব ভারতের টেলিকম বাজারে কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। জিও এবং এয়ারটেলের মতো বড় কোম্পানি স্টারলিঙ্ককে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে। তারা স্পেকট্রাম নিলামের মাধ্যমে বরাদ্দের দাবি জানালেও সরকার প্রশাসনিক বরাদ্দের পক্ষে। শহরে স্টারলিঙ্কের দাম বেশি হওয়ায় জিও ফাইবার বা এয়ারটেল এক্সট্রিমের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হতে পারে। কিন্তু গ্রামে, যেখানে বিকল্প নেই, সেখানে এটি একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। EY-ISpA-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের মহাকাশ অর্থনীতি ২০২৫ সালের মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে, যার একটি অংশ হতে পারে স্টারলিঙ্ক।
স্টারলিঙ্কের সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ দুটোই রয়েছে। এটি স্থাপন করা সহজ—একটি ডিশ ও রাউটার দিয়ে ব্যবহারকারীরা নিজেরাই সংযোগ চালু করতে পারবেন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাধ্যবাধকতাও নেই। তবে দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস, ব্যবসায়ীদের ডিজিটাল লেনদেন এবং স্বাস্থ্যসেবায় টেলিমেডিসিনের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হতে পারে। ভারতের ডিজিটাল বিভাজন কমাতে স্টারলিঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যদি এর দাম কিছুটা কমানো যায়।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, স্টারলিঙ্ক ভারতে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। এটি শুধু সংযোগ বাড়াবে না, বরং প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করবে। তবে সাফল্য নির্ভর করবে দাম নিয়ন্ত্রণ, সরকারি নীতি এবং প্রতিযোগিতার উপর। ২০২৫ সালের দিকে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখার অপেক্ষায় রয়েছে ভারত।