স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর কলকাতা থেকে সরিয়ে মুম্বাইয়ে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি উদ্বেগজনক ঘটনা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ব্যাঙ্কের গ্লোবাল মার্কেটিং ইউনিট, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা এখন কলকাতার পরিবর্তে মুম্বাই থেকে পরিচালিত হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যের আর্থিক ক্ষেত্রে প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া দীর্ঘদিন ধরে কলকাতাকে তার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। এই শহরে ব্যাঙ্কের ঐতিহ্য অনেক পুরনো, কারণ এটি একসময় ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮০৬ সালে। পরবর্তীতে ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল, ব্যাঙ্ক অফ বোম্বাই এবং ব্যাঙ্ক অফ মাদ্রাজ একত্রিত হয়ে ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া গঠিত হয়, যা ১৯৫৫ সালে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় রূপান্তরিত হয়। কলকাতা তখন থেকেই এই ব্যাঙ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। কিন্তু এখন গ্লোবাল মার্কেটিং ইউনিট স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে শহরের সেই গুরুত্ব অনেকটাই কমে যাচ্ছে। এই ইউনিটটি ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক ব্যবসা এবং বিনিয়োগ সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মুম্বাইয়ে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনা চলছে। অনেকে মনে করেন, মুম্বাই ভারতের আর্থিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত এবং সেখানে ব্যাঙ্কিং ও বিনিয়োগের পরিবেশ আরও উন্নত। স্টেট ব্যাঙ্ক সম্ভবত তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও কেন্দ্রীভূত করতে এবং গ্লোবাল মার্কেটের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এটি কলকাতার জন্য একটি বড় ধাক্কা। কারণ, এই ধরনের দফতর স্থানান্তরের ফলে শহরের আর্থিক কার্যকলাপে সরাসরি প্রভাব পড়বে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এবং ব্যাঙ্কের গ্রাহকরা এই সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, কলকাতার গুরুত্ব কমে গেলে রাজ্যের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবে বলা যায়, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ভারতের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। এর মোট সম্পদের পরিমাণ অনুযায়ী এটি বিশ্বের ৪৯তম বৃহৎ ব্যাঙ্ক। ২০২০ সালে ফরচুন গ্লোবাল ৫০০ তালিকায় এটি ২২১তম স্থানে ছিল। ব্যাঙ্কটির বাজারে ২৩% অংশীদারিত্ব রয়েছে এবং এটি ভারতের মোট ঋণ ও আমানতের ২৫% নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া, এটি দেশের পঞ্চম বৃহৎ নিয়োগকর্তা, যেখানে প্রায় ২,৫০,০০০ কর্মচারী কাজ করেন। কলকাতায় এই ব্যাঙ্কের বহু শাখা এবং গুরুত্বপূর্ণ দফতর রয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। তাই গ্লোবাল মার্কেটিং ইউনিটের স্থানান্তর কেবল একটি দফতর হারানোর বিষয় নয়, বরং রাজ্যের আর্থিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এই ঘটনা কলকাতার মানুষের জন্য একটি দুঃসংবাদ। ব্যাঙ্কের এই দফতরটি শহরে থাকলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা হতো। তারা সরাসরি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ব্যবসা বাড়াতে পারত। কিন্তু এখন মুম্বাইয়ে স্থানান্তর হওয়ায় অনেকের পক্ষে সেখানে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হবে না। ফলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। এছাড়া, এই সিদ্ধান্তের ফলে কলকাতায় ব্যাঙ্কের কর্মীদের মধ্যেও কিছু প্রভাব পড়তে পারে। যারা এই দফতরে কাজ করতেন, তাদের হয়তো মুম্বাইয়ে যেতে হবে বা অন্য কোনো কাজে বদলি হতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকে এটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির ফল হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের উপেক্ষার আরেকটি উদাহরণ এটি। তবে স্টেট ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে এখনও এই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। ব্যাঙ্কের অফিসিয়াল বিবৃতিতে শুধু জানানো হয়েছে যে, এটি তাদের ব্যবসায়িক কৌশলের অংশ। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কলকাতার গুরুত্ব কমিয়ে দেবে, এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।
শেষ কথা হিসেবে বলা যায়, স্টেট ব্যাঙ্কের এই পদক্ষেপ কলকাতার অর্থনীতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। শহরটি একসময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল এবং আর্থিক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গুরুত্ব কমছে। এই স্থানান্তর কেবল একটি দফতর হারানোর বিষয় নয়, বরং কলকাতার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। স্থানীয় মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা এখন এর প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।