পশ্চিমবঙ্গে ট্রাফিক আইনে এল বড় ধরনের পরিবর্তন। এখন থেকে রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় একটু ভুল হলেই পকেটে বড় ধাক্কা লাগবে। জরিমানার পরিমাণ ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে, আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেলে যাওয়ার শাস্তিও মাথায় ঝুলছে। রাজ্য সরকার এই নতুন নিয়মের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা জোরদার করতে চায়। আপনি যদি গাড়ি বা বাইক চালান, তাহলে এই নতুন আইনের খুঁটিনাটি জানা আপনার জন্য জরুরি।
গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারত সরকারের মোটরযান (সংশোধনী) আইন, ২০১৯-এর আলোকে রাজ্যে নতুন ট্রাফিক নিয়ম চালু হয়েছে। এই আইনের অধীনে পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন দপ্তর গত ২৪ জানুয়ারি, ২০২২-এ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি কিছু অপরাধের জন্য জেলের শাস্তি যোগ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই—রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানো আর দুর্ঘটনা কমানো। আগে যেখানে লাল সিগন্যাল অমান্য করলে ১০০ টাকা জরিমানা ছিল, সেখানে এখন ৫০০ টাকা থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত গুণতে হতে পারে। এমনকি বৈধ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে ৫,০০০ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে।
এই পরিবর্তনের পিছনে রাজ্যের সড়ক পরিস্থিতি একটি বড় কারণ। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ জনবহুল রাজ্য। এখানে গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শিল্প, পর্যটন আর ব্যবসার উন্নতির সঙ্গে যানবাহনের চাপও বেড়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে বেড়েছে ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার ঘটনা। পরিবহন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রাজ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী ছিল অতিরিক্ত গতি, মদ্যপান করে গাড়ি চালানো আর সিগন্যাল না মানা। তাই নতুন আইনে এই অপরাধগুলোর শাস্তি কঠোর করা হয়েছে।
নতুন নিয়মে কী কী পরিবর্তন এসেছে, তা একটু খোলসা করে দেখা যাক। আগে মদ্যপান করে গাড়ি চালালে জরিমানা ছিল ১,০০০ টাকা। এখন প্রথমবার ধরা পড়লে ১০,০০০ টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হতে পারে। দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে জরিমানা ১৫,০০০ টাকা আর জেল ২ বছর পর্যন্ত হতে পারে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য আগে ৪০০ টাকা জরিমানা ছিল, এখন তা বেড়ে ১,০০০ থেকে ২,০০০ টাকা হয়েছে। হেলমেট ছাড়া বাইক চালালে ১০০ টাকার জায়গায় এখন ১,০০০ টাকা দিতে হবে। এছাড়া, গাড়ির বীমা না থাকলে ২,০০০ টাকা আর পুনরাবৃত্তি হলে ৪,০০০ টাকা জরিমানা করা হবে।
এই নিয়মগুলো শুধু চালকদের জন্য নয়, পথচারীদেরও সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ব্যস্ত শহরগুলো, যেমন কলকাতা, হাওড়া বা দুর্গাপুরে প্রতিদিন লাখো মানুষ রাস্তায় চলাচল করেন। ট্রাফিক নিয়ম না মানলে শুধু চালক নয়, পথচারীরাও বিপদে পড়েন। পরিবহন দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “আমরা চাই মানুষ নিয়ম মেনে চলুক। জরিমানা বা শাস্তি দেওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হলো সড়ককে নিরাপদ করা।” তবে অনেকেই মনে করছেন, এত বেশি জরিমানা সাধারণ মানুষের পক্ষে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা আরও পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, আপনি লাল সিগন্যাল অমান্য করলেন। আগে ১০০ টাকা দিয়ে ছাড়া পেতেন। এখন প্রথমবার ৫০০ টাকা আর দ্বিতীয়বার ১,৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া ধরা পড়লে ৫,০০০ টাকা খরচ হবে। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালালে ১,০০০ টাকা জরিমানা। এমনকি গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকলেও ২,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এই তালিকা দেখে বোঝা যায়, সরকার এবার কঠোরভাবে নিয়ম মানাতে চায়।
এই নতুন আইন নিয়ে জনমত ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে বলছেন, এটা সড়ক নিরাপত্তার জন্য ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু অনেকের অভিযোগ, জরিমানার পরিমাণ এত বেশি যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা কঠিন। একজন বাইক চালক বলেন, “আমি দিনে ৫০০ টাকা রোজগার করি। হেলমেট না পরলে ১,০০০ টাকা জরিমানা দিলে আমার সংসার চলবে কীভাবে?” তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুরুতে কষ্ট হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটা সবার জন্য ভালো ফল দেবে।
শেষ কথা হলো, এই নিয়মগুলো জানা এবং মানা এখন আপনার হাতে। রাস্তায় গাড়ি চালানোর আগে লাইসেন্স, বীমা, ফিটনেস সার্টিফিকেট সব ঠিক আছে কিনা দেখে নিন। ট্রাফিক সিগন্যাল মানুন, গতি নিয়ন্ত্রণে রাখুন আর হেলমেট বা সিটবেল্ট ব্যবহার করুন। এতে আপনার টাকাও বাঁচবে, জীবনও নিরাপদ থাকবে। পশ্চিমবঙ্গে ট্রাফিক আইনের এই নতুন যুগে সচেতন হওয়াই এখন একমাত্র পথ।