যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি একটি গ্রাফিতি ঘিরে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে ‘আজাদ কাশ্মীর’ লেখা দেখা গেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনায় প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফেডারেশন বা PDSF-এর নাম জড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এই নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশ এই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই PDSF কারা এবং কেন তারা এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়ালো?
গত কয়েকদিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের একটি দেওয়ালে ‘আজাদ কাশ্মীর’ লেখা গ্রাফিতি চোখে পড়ে। এই লেখা দেখে অনেকেই হতবাক হয়ে যান। কাশ্মীর ভারতের একটি অংশ হলেও, ‘আজাদ কাশ্মীর’ শব্দটি সাধারণত পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরকে বোঝায়। এই গ্রাফিতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। কেউ কেউ এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে সমর্থন করলেও, অনেকে এটিকে দেশের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন। ঘটনাটি দ্রুত সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তদন্তে PDSF-এর নাম সামনে আসে, যারা এই গ্রাফিতির সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
এই ঘটনার পেছনের গল্প আরও গভীরে যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র রাজনীতির একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন সক্রিয়। PDSF বা প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফেডারেশন একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত। তারা সামাজিক ন্যায়বিচার, শিক্ষার অধিকার এবং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সোচ্চার। তবে এই গ্রাফিতি ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে এবং বলেছে যে এটি ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। অন্যদিকে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধী দল বিজেপি এই ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
PDSF-এর পরিচয় আরও স্পষ্ট করা দরকার। এই সংগঠনটি মূলত বামপন্থী ভাবধারার একটি গোষ্ঠী, যারা ছাত্রদের অধিকার ও সামাজিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। তারা CPI(M)-এর ছাত্র সংগঠন SFI-এর থেকে আলাদা একটি স্বাধীন গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করে। তাদের কার্যক্রমে সরকারবিরোধী আন্দোলন, প্রতিবাদ মিছিল এবং সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। তবে ‘আজাদ কাশ্মীর’ গ্রাফিতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের জড়িত থাকা অনেকের কাছেই অবাক করা ঘটনা। কারণ, এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে দিয়েছে। এই ঘটনার পর বিজেপি দাবি করেছে যে এটি দেশবিরোধী কার্যকলাপ, অন্যদিকে তৃণমূল বলছে এটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল।
ঘটনাটির প্রভাব ক্যাম্পাসের বাইরেও ছড়িয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে এই গ্রাফিতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। অনেকে মনে করছেন, এটি ছাত্রদের মতপ্রকাশের অধিকারের অংশ। আবার কেউ কেউ বলছেন, এ ধরনের লেখা জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি। পুলিশ তদন্তে জানিয়েছে, তারা CCTV ফুটেজ ও অন্যান্য প্রমাণ সংগ্রহ করছে। তবে PDSF এখনও এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ এই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল করেছে, আবার অনেকে এটির বিরোধিতা করছে। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বিষয়টির গভীরতা বোঝার জন্য আরও কিছু তথ্য জানা দরকার। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। ২০১৯ সালে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন এবং অন্যান্য প্রতিবাদে এখানকার ছাত্ররা সক্রিয় ছিল। PDSF-এর মতো সংগঠনগুলো প্রায়ই সরকারের নীতি বা আন্তর্জাতিক বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে। তবে এই গ্রাফিতি যদি তাদের কাজ হয়, তবে এটি তাদের সাধারণ কার্যক্রম থেকে ভিন্ন একটি পদক্ষেপ। তদন্তে যদি তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে, তবে এটি আইনি ও রাজনৈতিকভাবে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে, এই ঘটনা এখনও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। PDSF-এর ভূমিকা, তাদের উদ্দেশ্য এবং এই গ্রাফিতির পেছনের কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এটি নিশ্চিত যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিতর্ক শুধু ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। পুলিশ তদন্তের ফলাফলের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এখন দেখার বিষয়, এই ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয়।