Best foods for sleep at night: আপনি কি রাতে ভালো ঘুমাতে পারেন না? আধুনিক জীবনযাত্রায় ঘুমের সমস্যা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে খাদ্যাভ্যাস আমাদের ঘুমের মান উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু নির্দিষ্ট খাবার এমন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ যা ঘুমের হরমোন তৈরি করতে সাহায্য করে এবং শরীরকে বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত করে। আসুন জেনে নেই এমন ৭টি খাবার সম্পর্কে যা আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে।
কিউই ফল: প্রাকৃতিক ঘুমের সহায়ক
কিউই ফল ভিটামিন C, ই, পটাসিয়াম এবং ফোলেট সমৃদ্ধ একটি ফল যা ঘুমের সমস্যা দূর করতে অত্যন্ত কার্যকরী। গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে দুটি কিউই খেলে ঘুমের সময় বাড়ে, ঘুমের মান উন্নত হয় এবং ঘুমাতে কম সময় লাগে।
কিউই ফলে সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার থাকে যা ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ঘুমানোর আগে দুটি কিউই খেলে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ে, যা আপনাকে দ্রুত ঘুমাতে এবং দীর্ঘক্ষণ ঘুমাতে সাহায্য করে।
কিউই ফলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, যা ঘুমের পাটার্নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। নিয়মিত কিউই খাওয়া ঘুমের গুণমান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে এবং ঘুমের সাথে সম্পর্কিত সমস্যাগুলি কমাতে সাহায্য করে।
টক চেরি: মেলাটোনিনের প্রাকৃতিক উৎস
চেরি খাওয়া শুধু স্বাদেই নয়, ঘুমের জন্যও উপকারী। বিশেষ করে টক চেরি বা সাওয়ার চেরি মেলাটোনিনের একটি প্রাকৃতিক উৎস, যা ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত টক চেরির জুস পান করলে অনিদ্রার লক্ষণগুলি কমে যায় এবং ঘুমের সময় বাড়ে4। প্রতিদিন দুই কাপ টক চেরির জুস পান করা ঘুমের সময় বাড়াতে এবং ঘুমের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
টক চেরিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ঘুমের মান উন্নত করতে পারে। এক গবেষণায় পাওয়া গেছে যে টক চেরি অক্সিডেটিভ ক্ষতি কমিয়ে ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। মন্টমোরেন্সি নামক একটি জনপ্রিয় টক চেরি ধরনের নিয়মিত সেবন ঘুমের গুণমান ও পরিমাণ উন্নত করে।
বাদাম ও অন্যান্য নাট্স: ম্যাগনেসিয়াম ও মেলাটোনিন সমৃদ্ধ
বাদাম শুধু স্বাস্থ্যকর নাস্তা হিসেবেই নয়, বরং ঘুমের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। বাদামে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও মেলাটোনিন রয়েছে, যা ঘুমের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
ম্যাগনেসিয়াম কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা অনিদ্রার মূল কারণ হতে পারে8। এটি শরীরের পেশী ও স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করে, যা গভীর ও পুনরুজ্জীবিত ঘুমকে উৎসাহিত করে।
বাদাম ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন মেলাটোনিন সমৃদ্ধ, যা আপনার অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে সমর্থন করে এবং ঘুমে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ করে। আপনি বাদাম দুধ বা ভিজিয়ে রাখা বাদাম হিসেবেও খেতে পারেন।
অন্যান্য নাট্স যেমন আখরোট, কাজু ইত্যাদিও ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। আখরোটে মেলাটোনিন, সেরোটোনিন এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো কয়েকটি যৌগ রয়েছে যা ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রচার করে।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: প্রাচীন ঘুমের ঔষধ
ঘুমানোর আগে গরম দুধ পান করা একটি প্রাচীন উপায় যা ঘুমকে উৎসাহিত করে। গরম দুধ সেরোটোনিন ও মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে, যা বিশ্রাম ও ঘুমকে সমর্থন করে।
দুধে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা পেশী ও স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করতে সাহায্য করে, যা গভীর ও আরাম দায়ক ঘুমকে উৎসাহিত করে। যারা ডেয়রি এড়িয়ে চলেন তারা ওট মিল্ক বা বাদাম দুধ দিয়ে এটি প্রতিস্থাপন করতে পারেন।
দই, পনির ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্যগুলি ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের ভালো উৎস, যা ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে দুধ বয়স্কদের ঘুম উন্নত করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন হালকা ব্যায়ামের সাথে যুক্ত হয়।
ফ্যাটি ফিশ: ভিটামিন ডি ও ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ
সামুদ্রিক খাবার পছন্দ করেন? তাহলে স্যামন, ম্যাকেরেল এবং সার্ডিনস মতো ফ্যাটি মাছ ঘুমানোর আগে খাওয়ার জন্য চমৎকার পছন্দ। এগুলি ভিটামিন ডি এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ, যা সেরোটোনিন নিয়ন্ত্রণ এবং মেলাটোনিন উৎপাদন বাড়িয়ে ভালো ঘুম প্রচার করতে সাহায্য করে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত ফ্যাটি মাছ খাওয়া ভিটামিন ডি এর মাত্রা বাড়ায় এবং হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আনতে পারে যা ঘুমের মান উন্নত করে। ফ্যাটি মাছ খাওয়া ঘুমাতে যাওয়া সহজ করে তোলে এবং মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকেও সমর্থন করে।
ফ্যাটি মাছ একাধিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ যেমন – পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক, ভিটামিন বি-১২, ফোলেট এবং ক্যালসিয়াম, যা সবই ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
ক্যামোমাইল চা: প্রাকৃতিক শান্তিদায়ক
ঘুমানোর আগে এক কাপ ক্যামোমাইল চা বিশ্রাম নেওয়ার চমৎকার উপায়। ক্যামোমাইল চা এর শান্ত করার প্রভাব জন্য পরিচিত, যা উদ্বেগ কমাতে এবং বিশ্রাম প্রচার করতে সাহায্য করে।
ক্যামোমাইল চায়ে অ্যাপিজেনিন নামক একটি ফ্লাভোনয়েড যৌগ থাকে যা GABA A রিসেপ্টরগুলিকে সক্রিয় করে, একটি প্রক্রিয়া যা ঘুম উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে। এটি একটি ব্যস্ত দিনের পরে উপভোগ করার জন্য নিখুঁত পানীয়, আপনার শরীরকে ধীর হওয়ার সময় নির্দেশ করে।
ক্যামোমাইল চায়ের কার্যকারিতা বাড়াতে আপনি এতে দারুচিনি যোগ করতে পারেন। ঘুমানোর আগে ক্যামোমাইল চা পান করা একটি শান্তিপূর্ণ রাতের বিশ্রামের জন্য আপনার শরীরকে প্রস্তুত করতে সাহায্য করে।
ওটমিল ও হোল গ্রেইন্স: জটিল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ
ওটমিল এবং অন্যান্য হোল গ্রেইন্স ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। ওটমিল রাইসের মতো কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ, কিন্তু এতে আরও বেশি ফাইবার রয়েছে এবং ঘুমানোর আগে খেলে ঘুম আনতে সাহায্য করে বলে জানা যায়।
জটিল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারগুলি ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিডের বিপাককে সমর্থন করে যা শরীরে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে। এই হরমোনগুলি ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং গভীর বিশ্রাম প্রচার করে।
ওটমিল মেলাটোনিনের একটি পরিচিত উৎস এবং নিয়মিত খাওয়া ঘুমের সমস্যাগুলি কমাতে সাহায্য করতে পারে। অন্যান্য হোল গ্রেইন্স যেমন কুইনোয়াও ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
ঘুমের জন্য অতিরিক্ত খাবার যা সাহায্য করে
এছাড়াও আরও কিছু খাবার রয়েছে যা আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে:
পালং শাক ও সবুজ শাকসবজি: ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পালং শাক ঘুমের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে3। ক্যালসিয়াম মস্তিষ্ককে ট্রিপটোফ্যান ব্যবহার করে ঘুম আনতে সাহায্য করে।
ফ্ল্যাক্সসিড: মেলাটোনিন, ট্রিপটোফ্যান এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ, এই পুষ্টি উপাদানগুলি ভালো ঘুম আনতে এবং শান্ত প্রভাব বাড়াতে জড়িত।
অলিভ: মেলাটোনিন সমৃদ্ধ অলিভ আপনার খাবারের পুষ্টিমান বাড়ানোর পাশাপাশি আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
কলা: ম্যাগনেসিয়ামের একটি মাঝারি উৎস, কলা আপনাকে ভালো ঘুমাতে সাহায্য করতে পারে।
ঘুমের পুষ্টি: একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ
ভালো ঘুমের জন্য শুধু নির্দিষ্ট খাবার খাওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং সামগ্রিক পুষ্টি অভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ। “ঘুমের প্রচারক খাবারের মধ্যে রয়েছে ট্রিপটোফ্যান (একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা সেরোটোনিন মুক্তিতে সাহায্য করে), ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ডি এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার,” বিশেষজ্ঞরা বলেন।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্য রক্তের শর্করার মাত্রা পরিচালনা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে, যা ব্যথা প্রতিরোধ এবং ভাল ঘুম পাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট (কার্বস, ফ্যাট এবং প্রোটিন) পাওয়া আপনার শরীরকে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিনের মতো শান্ত করার রাসায়নিক তৈরি করতে সাহায্য করে, যা আপনাকে বিশ্রাম নিতে এবং ঘুমন্ত বোধ করতে সাহায্য করে।
ঘুমের আগে এড়িয়ে চলুন এই খাবারগুলি
যেমন কিছু খাবার ঘুমের মান উন্নত করতে সাহায্য করে, তেমনি কিছু খাবার ঘুমে বাধা দিতে পারে। ঘুমানোর আগে নিম্নলিখিত খাবারগুলি এড়িয়ে চলা উচিত:
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় (কফি, চা, কোলা)
অ্যালকোহল
ভারী খাবার
অত্যধিক মসলাযুক্ত খাবার
অত্যধিক চিনিযুক্ত খাবার
ঘুমের মান উন্নত করতে খাদ্যাভ্যাস একটি প্রাকৃতিক ও কার্যকর উপায়। কিউই ফল, টক চেরি, বাদাম, দুধ, ফ্যাটি মাছ, ক্যামোমাইল চা এবং ওটমিল সহ আমাদের আলোচিত ৭টি খাবার নিয়মিত খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে আপনি ঘুমের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন।
মনে রাখবেন, কোনো একটি খাবারই যাদুকরী সমাধান নয়, বরং সামগ্রিক পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস অবলম্বন করাই সবচেয়ে ভালো। ঘুমের আগে ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন এবং নিয়মিত সময়ে খাওয়া ও ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন। এই পরিবর্তনগুলি আপনার ঘুমের মান উন্নত করতে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে।