আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গত বছরের আগস্টে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনার পর শুরু হওয়া আন্দোলনের অন্যতম মুখ সুবর্ণ গোস্বামীকে সম্প্রতি দার্জিলিংয়ে বদলি করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে আরজি কর আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে বদলি হয়েও থেমে নেই এই চিকিৎসক। রুটিন বদলির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি, যা চিকিৎসক মহলে নতুন আলোড়ন তুলেছে। আজ, ২০ মার্চ ২০২৫, ফের স্বাস্থ্যভবন অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে এই ঘটনার প্রতিবাদে।
গত বছর আরজি কর হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক সমাজে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জুনিয়র চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। ন্যায়বিচারের দাবিতে তিনি শুধু রাস্তায় নেমে বিক্ষোভই করেননি, বরং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য সরকারের কাছে একাধিক দাবি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তাকে আরজি কর থেকে দার্জিলিংয়ে বদলি করা হয়। অনেকে মনে করছেন, এটি তার আন্দোলনের সক্রিয় ভূমিকার জন্য একটি ‘শাস্তি’। এই বদলির পর সুবর্ণ স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি লড়াই থামাবেন না। রুটিন বদলির নামে চিকিৎসকদের উপর চাপ সৃষ্টির বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছেন এবং সহকর্মীদের একসঙ্গে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত গত বছরের ৯ আগস্ট। আরজি কর মেডিকেল কলেজে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয় হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ধর্ষণ ও হত্যার প্রমাণ মেলে। এই ঘটনা শুধু চিকিৎসকদের মধ্যেই নয়, গোটা সমাজে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। জুনিয়র চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামেন। সুবর্ণ গোস্বামী ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তিনি ও তার সহকর্মীরা হাসপাতালে সিসি ক্যামেরা, পুলিশ আউটপোস্ট এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েনের দাবি জানান। এছাড়াও, তদন্তে স্বচ্ছতা ও দোষীদের দ্রুত শাস্তির দাবিতে তারা স্বাস্থ্যভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান। আন্দোলনের চাপে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও, অনেকে মনে করেন যে পুরোপুরি ন্যায়বিচার এখনও মেলেনি। এর মধ্যেই সুবর্ণের বদলির খবর এসেছে, যা চিকিৎসকদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করেছে।
এই বদলির পিছনে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য উঠে আসছে। আরজি কর আন্দোলনের পর থেকে সরকারের সঙ্গে চিকিৎসকদের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, হাসপাতালে নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি চিকিৎসকদের উপর অহেতুক প্রশাসনিক চাপ কমাতে হবে। কিন্তু বদলির মতো সিদ্ধান্তে অনেকে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সূত্রের খবর, সুবর্ণ গোস্বামীকে দার্জিলিংয়ে পাঠানোর নির্দেশ এসেছে স্বাস্থ্য দফতর থেকে। এই জেলায় চিকিৎসক সংকট রয়েছে বলে জানা গেলেও, তার বদলিকে অনেকে ‘প্রতিশোধমূলক’ বলে মনে করছেন। এদিকে, আন্দোলনের সমর্থনে গড়ে ওঠা ‘অভয়া মঞ্চ’ এই বদলির তীব্র নিন্দা করেছে এবং আজ স্বাস্থ্যভবন ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছে।
চিকিৎসকদের রুটিন বদলি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রায়ই দেখা যায়, চিকিৎসকদের হঠাৎ করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো হয়। এতে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি রোগীদের সেবাও ব্যাহত হয়। সুবর্ণ গোস্বামী এই প্রথা বন্ধের দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, “আমরা রোগীদের জন্য কাজ করি, কিন্তু এভাবে বদলি করলে আমাদের মনোবল ভেঙে যায়। এটা শুধু আমার লড়াই নয়, সব চিকিৎসকের জন্য লড়াই।” তার এই বক্তব্যে অনেক চিকিৎসক একমত পোষণ করেছেন। গত কয়েক মাসে আরজি কর কাণ্ডের তদন্ত নিয়েও সরকারের উপর চাপ বেড়েছে। সিবিআই তদন্ত চললেও, এখনও পুরোপুরি ফলাফল প্রকাশ্যে আসেনি। এই পরিস্থিতিতে সুবর্ণের বদলি আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করেছে।
এই ঘটনা শুধু চিকিৎসকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাধারণ মানুষও এই বিষয়ে সোচ্চার হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সুবর্ণ গোস্বামীর সমর্থনে অনেকে লিখছেন। একজন লিখেছেন, “যারা ন্যায়ের জন্য লড়েন, তাদের এভাবে শাস্তি দেওয়া হলে সমাজে আর কে সত্যের পক্ষে দাঁড়াবে?” আরজি কর কাণ্ডের পর ‘মেয়েরা রাতের দখল নাও’ নামে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রশ্ন আজও গুরুত্বপূর্ণ। সুবর্ণের বদলি এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সুবর্ণ গোস্বামী ও তার সহকর্মীরা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। আজকের স্বাস্থ্যভবন অভিযানে কতজন যোগ দেবেন, তা দেখার বিষয়। চিকিৎসকদের এই প্রতিবাদ কেবল নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নয়, সমাজের সুস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যও। সুবর্ণের কথায়, “আমরা হারব না, কারণ আমাদের লড়াই সত্যের পক্ষে।” এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর নতুন করে আলোকপাত করেছে।