How to protect eyes in summer: মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল অঙ্গ হল চোখ। গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড তাপমাত্রায় চোখ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়, যা থেকে যথাযথ যত্ন না নিলে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। আবহাওয়ার তারতম্যে চোখের স্বাস্থ্যের বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়, এবং গরমকালে অতিরিক্ত তাপ, ধুলাবালি ও দূষণ চোখের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ত্বকের যত্নের মতো চোখেরও বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন, কারণ সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে আমরা যেমন ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন ব্যবহার করি, চোখেরও একই রকম সুরক্ষা প্রয়োজন।
এই ব্লগে আমরা গ্রীষ্মকালীন তাপে চোখের যত্ন ও সুরক্ষার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আলোচনা করব, যা আপনাকে এই মৌসুমে চোখের বিভিন্ন সমস্যা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।
গ্রীষ্মকালে চোখে দেখা দেয় এমন সমস্যাসমূহ
গ্রীষ্মকালে চোখ নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেসব সমস্যা এই ঋতুতে বেশি দেখা যায়, সেগুলি সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
চোখের অ্যালার্জি: অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও দূষণের কারণে চোখে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে চোখ চুলকায় এবং লালচে রং ধারণ করে। বিশেষ করে রোদে গেলে চোখ জ্বালাপোড়া করতে পারে।
চোখের অঞ্জলি: এই সমস্যায় চোখের পাতা ফুলে যায়, লাল হয় এবং ব্যথা অনুভূত হয়। অঞ্জলি সাধারণত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হয়ে থাকে।
গ্রীষ্মকালে সুস্থ থাকুন: এই ৫টি ফল রাখবে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে
চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া: গরমে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে চোখ শুকনো (ড্রাই আই) হতে পারে, যা অস্বস্তির কারণ হয়।
অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব: দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের রোদে থাকলে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে চোখের ক্ষতি হতে পারে।
কনজাংটিভাইটিস: গরমের সময় অন্য ঋতুর তুলনায় কনজাংটিভাইটিস বেশি দেখা যায়। এটি চোখের সাদা অংশ ও পাতার ভিতরের অংশে হয়, প্রধানত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া অথবা অ্যালার্জির কারণে।
কনজাংটিভাইটিসের লক্ষণসমূহ
কনজাংটিভাইটিস গরমকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এমন চোখের সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। এটি চিনতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া সহজ হয়:
-
চোখ লাল হয়ে যাওয়া
-
চোখের রক্তনালিগুলি ফুলে যাওয়া
-
ঘুম থেকে ওঠার পর চোখে আঠালো ভাব অনুভব করা
-
চোখের ভিতর কিছু একটা পড়েছে এমন অনুভূতি হওয়
-
চোখে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া অনুভব কর
-
আলোর দিকে তাকালে অস্বস্তি হওয়া এবং সব কিছু ঘোলা দেখা
এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে এই সমস্যা দ্রুত নিরাময় হয়।
গ্রীষ্মে চোখের সুরক্ষার জন্য করণীয়
গ্রীষ্মের তাপ ও দাবদাহে চোখকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি নিতে হবে:
রোদচশমা ব্যবহার করুন: রোদ থেকে চোখকে বাঁচাতে রোদচশমা পরার বিকল্প নেই। ভালো মানের UV প্রোটেকশন সহ রোদচশমা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে চোখকে শতভাগ সুরক্ষা দেয়।
হ্যাট বা ছাতা ব্যবহার করুন: বাইরে বেরোলে মাথায় টুপি বা ছাতা ব্যবহার করুন যাতে চোখে সরাসরি সূর্যের আলো না পড়ে।
এসির হাওয়া থেকে চোখকে রক্ষা করুন: শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের (এসি) সরাসরি হাওয়া চোখে লাগলে চোখ আরও শুষ্ক হতে পারে। তাই যেখানে কাজ করেন, সেখানে এসি এমনভাবে সেট করুন যাতে হাওয়া সরাসরি চোখে না লাগে।
পর্যাপ্ত ঘুম নিন: চোখের বিশ্রামের জন্য প্রতিদিন ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো অত্যন্ত জরুরি।
ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে বিরতি নিন: দীর্ঘ সময় ল্যাপটপ-কম্পিউটারে কাজ করার সময় নিয়মিত বিরতি নিন এবং চোখের কিছু ব্যায়াম করুন।
চোখ পরিষ্কার রাখুন: দিনের মধ্যে কয়েকবার পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন। এমনকি চোখে পানির ঝাপটাও দিতে পারেন, যা চোখের ভিতর থেকে ময়লা পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
শসার টুকরো ব্যবহার করুন: বিশ্রামের সময় চোখের ওপর পাতলা করে কেটে নেওয়া শসার টুকরো রাখতে পারেন। এটি চোখ ঠান্ডা ও আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে।
কনজাংটিভাইটিস প্রতিরোধের উপায়
গরমের সময় কনজাংটিভাইটিস এড়াতে নিম্নলিখিত সাবধানতা অবলম্বন করুন:
বারবার হাত ধোয়া: কোভিডের সময় যেমন হাত ধোয়ার অভ্যাস ছিল, সেইভাবে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এর চেয়ে ভালো উপায় নেই। ব্যাগে অবশ্যই স্যানিটাইজার রাখুন।
রোগীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন: বাড়িতে কারও কনজাংটিভাইটিস হলে বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কোনও আক্রান্ত ব্যক্তির সম্মুখীন হলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। মনে রাখবেন, রোগী যদি চোখে হাত দিয়ে কোনও জায়গা স্পর্শ করেন এবং আপনি ওই একই জায়গা স্পর্শ করে চোখে হাত দেন, তবে আপনিও সংক্রমিত হতে পারেন।
ব্যক্তিগত জিনিস ভাগাভাগি করবেন না: তোয়ালে, বালিশের কভার, রুমালের মতো জিনিসগুলি বাড়িতে কারও সঙ্গে ভাগ করবেন না। সৌন্দর্য প্রসাধনীও কারও সাথে শেয়ার করবেন না বা অন্যের ব্যবহৃত প্রসাধনী ব্যবহার করবেন না।
চোখে চশমা পরুন: বাইরে বেরোলে চোখে চশমা পরুন। পাওয়ার না থাকলেও সুরক্ষার জন্য পাওয়ার ছাড়া চশমা ব্যবহার করতে পারেন। এতে চোখ সুরক্ষিত থাকবে এবং চোখে হাত দেওয়ার প্রবণতাও কমবে। সাঁতার কাটার সময়েও চোখে গগগলস পরুন।
অনধিকৃত অ্যাই ড্রপ ব্যবহার করবেন না: আক্রান্ত হলে বাজারচলতি যে কোনও আই ড্রপ ব্যবহার না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অনধিকৃত চোখের ড্রপ কর্নিয়ার ক্ষতি করতে পারে।
চোখের স্বাস্থ্যে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস
চোখের স্বাস্থ্য শুধু বাহ্যিক যত্নেই নয়, সঠিক খাদ্যাভ্যাসেও নির্ভর করে। গরমকালে চোখের সুস্থতা বজায় রাখতে খাদ্যাভ্যাসে নিম্নলিখিত পুষ্টিকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন:
সবুজ শাকসবজি: প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সবুজ শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করুন, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি সরবরাহ করে।
ফলমূল: বিভিন্ন রঙের ফল, বিশেষ করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল চোখের জন্য উপকারী।
গাজর: গাজরে থাকা বিটা-ক্যারোটিন চোখের দৃষ্টিশক্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বাদাম: বাদামে থাকা ভিটামিন ই চোখকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে।
কলিজা: কলিজাতে ভিটামিন এ প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা দৃষ্টিশক্তির জন্য অত্যন্ত উপকারী।
প্রচুর পানি পান করুন: দেহে যথেষ্ট পরিমাণে পানি থাকলে চোখের আর্দ্রতা বজায় থাকে এবং শুষ্কতা কমে।
চোখের যত্নে কর্মক্ষেত্রে ও বাড়িতে বিশেষ সতর্কতা
গরমের দিনে কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে থাকাকালীন চোখের যত্নে কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি:
ল্যাপটপ-কম্পিউটারের ব্যবহার: দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের সামনে কাজ করার সময় প্রতি 20 মিনিটে 20 সেকেন্ডের জন্য 20 ফুট দূরের কোনও বস্তুর দিকে তাকানোর অভ্যাস করুন। এটি চোখের ক্লান্তি কমায়।
ঘরের আর্দ্রতা বজায় রাখুন: এসি ব্যবহারের সময় ঘরের আর্দ্রতা বজায় রাখতে হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন, যা চোখের শুষ্কতা কমায়।
সঠিক আলোর ব্যবস্থা: ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে সঠিক আলোর ব্যবস্থা করুন যাতে চোখে চাপ না পড়ে। কম্পিউটার স্ক্রিনের ব্রাইটনেস পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখুন।
নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করান: নিয়মিতভাবে চোখের বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে চোখের পরীক্ষা করান, বিশেষ করে যদি আপনি কোনও সমস্যা অনুভব করেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ কখন নিবেন
চোখের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন:
-
চোখে অস্বাভাবিক লালভাব দেখা দিলে
-
চোখ থেকে পানি পড়া বা আঠালো পদার্থ নির্গত হলে
-
চোখে অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব করলে
-
দৃষ্টিশক্তিতে হঠাৎ পরিবর্তন আসলে
-
আলোর প্রতি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা বাড়লে
-
কনজাংটিভাইটিসের লক্ষণ দেখা দিলে
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ এ কে আজাদ, চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, চক্ষুরোগ বিভাগ, আল-রাজী হাসপাতাল, ঢাকা-এর মতে, “চোখের অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।”1 সঠিক নিয়মে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ড্রপ ব্যবহার করলে মাত্র পাঁচ-সাত দিনেই কনজাংটিভাইটিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
গ্রীষ্মকালে তাপদাহ, ধুলাবালি, আর্দ্রতার অভাব এবং অতিবেগুনি রশ্মির কারণে চোখ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে সঠিক সতর্কতা ও যত্ন নিলে এই সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। নিয়মিত রোদচশমা ব্যবহার, হাত পরিষ্কার রাখা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার মাধ্যমে আপনি গরমকালেও চোখের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারেন।
চোখ আমাদের মূল্যবান সম্পদ। এর যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সঠিক যত্ন ও সতর্কতার মাধ্যমে আমরা গরমকালেও চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারি এবং উজ্জ্বল দৃষ্টি বজায় রাখতে পারি।