দীর্ঘ নয় মাস মহাকাশে আটকে থাকার পর অবশেষে পৃথিবীর মাটিতে পা রাখলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নভশ্চর সুনীতা উইলিয়ামস। বুধবার, ১৯ মার্চ ভারতীয় সময় ভোর ৪টা ২৬ মিনিটে ফ্লোরিডার উপকূলে স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলে করে নিরাপদে অবতরণ করেন তিনি। হাসিমুখে ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববাসীর উদ্বেগের অবসান ঘটান সুনীতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও তিন মহাকাশচারী—বুচ উইলমোর, নিক হেগ এবং আলেকজান্ডার গরবুনভ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি শুধু তাঁদের পরিবারের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য একটি আনন্দের দিন হয়ে উঠেছে।
গত বছরের ৫ জুন সুনীতা এবং বুচ বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল মাত্র ৮ দিনের একটি মিশন। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাঁদের ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। স্টারলাইনারে হিলিয়াম লিক এবং থ্রাস্টারের সমস্যা ধরা পড়ায় নাসা ঝুঁকি নিতে চায়নি। ফলে, এই দুই নভশ্চরকে আইএসএস-এ থেকে যেতে হয়। শেষ পর্যন্ত ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুল তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মঙ্গলবার ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আইএসএস থেকে যাত্রা শুরু করে এই যান। প্রায় ১৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে বুধবার ভোরে ফ্লোরিডার গাল্ফ অফ মেক্সিকোতে প্যারাসুটের সাহায্যে স্প্ল্যাশডাউন করে ক্যাপসুলটি।

এই ঘটনার বিবরণ যেন একটি রোমাঞ্চকর গল্পের মতো। সুনীতা এবং বুচ যখন মহাকাশে পাড়ি দেন, তখন সবাই ভেবেছিল এটি একটি স্বাভাবিক মিশন হবে। কিন্তু স্টারলাইনারের ত্রুটির কারণে পরিস্থিতি বদলে যায়। নাসা বেশ কয়েকবার তাঁদের ফেরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষে স্পেসএক্সের ক্রু-৯ মিশনের মাধ্যমে তাঁদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়। গত ১৫ মার্চ ফ্যালকন-৯ রকেটে ড্রাগন ক্যাপসুল উৎক্ষেপণ করা হয়। এই যানে আরও চারজন মহাকাশচারী—অ্যান ম্যাকক্লেইন, নিকোল আয়ার্স, তাকুয়া ওনিশি এবং কিরিল পেসকভ—আইএসএস-এ পৌঁছে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর সুনীতারা ড্রাগন ক্যাপসুলে চড়ে পৃথিবীর পথে রওনা দেন। অবতরণের সময় আবহাওয়া অনুকূল ছিল, আকাশ পরিষ্কার থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। চারটি প্যারাসুটের সাহায্যে ক্যাপসুলটি নিরাপদে সমুদ্রে নামে।
এই যাত্রার গভীরতা বোঝার জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা দরকার। সুনীতা উইলিয়ামসের এটি প্রথম মহাকাশ অভিযান নয়। এর আগে ২০০৬ এবং ২০১২ সালে তিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন, মোট ৩২২ দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে আলাদা। ২৯৬ দিন আইএসএস-এ কাটানোর এই সময়টি আমেরিকার ইতিহাসে ষষ্ঠ দীর্ঘতম মহাকাশ অবস্থান হিসেবে গণ্য হয়েছে। তুলনায়, রাশিয়ান নভশ্চর ভ্যালেরি পলিয়াকভ ৪৩৭ দিন মহাকাশে কাটিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। সুনীতার এই মিশন শুধু তাঁর সাহসই নয়, মহাকাশ গবেষণায় নাসা ও স্পেসএক্সের প্রযুক্তিগত দক্ষতাও প্রমাণ করেছে।

অবতরণের পর কী হল? সমুদ্রে নামার পর একটি উদ্ধারকারী জাহাজ ক্যাপসুলটি তুলে নেয়। নাসার মেডিকেল টিম চারজন মহাকাশচারীকে একে একে বের করে আনে। সুনীতা ও বুচ দীর্ঘদিন মহাকাশে থাকায় তাঁদের জন্য বিশেষ সতর্কতা নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁদের ফ্লোরিডা থেকে হিউস্টনে নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৪৫ দিনের রিহ্যাব প্রোগ্রামে তাঁদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা হবে। দীর্ঘদিন শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার ফলে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন পেশির ক্ষয়, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা বা ‘বেবি ফিট’ নামে পরিচিত পায়ের তলার সংবেদনশীলতা।
সুনীতার পৈতৃক গ্রাম গুজরাটের মেহসানা জেলার ঝুলসানায় এই প্রত্যাবর্তন উৎসবের রূপ নিয়েছে। গ্রামবাসীরা রাত জেগে টিভিতে লাইভ সম্প্রচার দেখেছেন। দেবী দোলা মাতার মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা ও অখণ্ড জ্যোতি জ্বালিয়ে তাঁরা অপেক্ষা করেছিলেন। অবতরণের মুহূর্তে জয়ধ্বনি আর পটকাবাজিতে মেতে ওঠে গ্রাম। সুনীতার তুতো ভাই নবীন পাণ্ড্য বলেন, “৯ মাস ধরে এই দিনের জন্য অপেক্ষা করেছি।” বিশ্বের কোটি মানুষও নাসার এক্স হ্যান্ডলে লাইভ কভারেজের মাধ্যমে এই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন।
এই ঘটনা শুধু একটি প্রত্যাবর্তন নয়, মানুষের সাহস ও প্রযুক্তির জয়গান। সুনীতা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মহাকাশে থাকার ফলে তিনি একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছেন, যা তিনি হারাতে চান না। তাঁর এই যাত্রা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।