পশ্চিমবঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ২৬ হাজার চাকরি বাতিল মামলায় রাজ্য সরকার ও কমিশনের রিভিউ পিটিশন খারিজ করেছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট, ২০২৫) বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি সতীশচন্দ্র শর্মার বেঞ্চ সব রকম পুনর্বিবেচনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে গত এপ্রিলে দেওয়া চাকরি বাতিলের নির্দেশ বহাল রেখেছে। এই রায়ের ফলে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চাকরি ফেরত পাওয়ার আইনি পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে যে নিয়োগ প্রক্রিয়ার আসল ওএমআর শিট বা তার মিরর কপি না থাকা, সিবিআই তদন্তে দুর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের গুরুতর গাফিলতির কারণে রায় পুনর্বিবেচনার কোনো প্রয়োজন নেই। আদালত জোর দিয়ে বলেছে যে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াই ব্যাপক কারচুপি ও দুর্নীতিতে কলুষিত হয়েছিল, যা সংশোধনের অযোগ্য।
দুর্নীতির এই কেলেঙ্কারি প্রথম আলোচনায় এসেছিল ২০২২ সালের জুলাই মাসে যখন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট গ্রেফতার করে। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অর্পিতা মুখার্জির বাসা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা নগদ ও মূল্যবান অলংকার উদ্ধার হয়। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পর কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ খুঁজে পায়।
পরবর্তীতে কলকাতা হাইকোর্ট গত বছর ২২ এপ্রিল ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগের সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দেয়। হাইকোর্টের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার ও এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলেও এ বছরের ৩ এপ্রিল শীর্ষ আদালত হাইকোর্টের রায়কেই সমর্থন জানায়। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছিল যে যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করা সম্ভব নয় বলে পুরো প্যানেলই বাতিল করা হচ্ছে।
এই রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজ্য সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা মোট প্রায় ২০০টি রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। রাজ্যের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি বাতিল হলে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মারাত্মক ক্ষতি হবে। অনেক স্কুলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শূন্য হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল।
তবে সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে যে মূল রোগ নিরাময় না করে কেবল উপসর্গের চিকিৎসা করা যায় না। আদালত বলেছে যে নিয়োগ কমিশনের দায়িত্বহীনতা ও তথ্য গোপনের চেষ্টা পুরো প্রক্রিয়াকে কলুষিত করেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রণজিৎ বাগের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টেও ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।
দুর্নীতির এই কেলেঙ্কারি কেবল চাকরি বিতরণেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে যে প্রার্থীদের কাছ থেকে চাকরির বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। এমনকি সাদা কাগজ জমা দিয়েও অনেকে চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে ‘র্যাঙ্ক জাম্প’ ও প্যানেল-বহির্ভূত নিয়োগের মতো গুরুতর অনিয়মের কথা।
শিক্ষাব্যবস্থায় এই ধাক্কা সামলাতে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ৪৪,২০৩টি শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীর পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিতে জড়িত থাকা প্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ থাকবে না বলে কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে।
মামলার একটি আশ্চর্যজনক দিক হলো যে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও সিবিআইয়ের চার্জশিটে এসেছে। তদন্তকারী সংস্থার অভিযোগ অনুযায়ী, অবৈধ নিয়োগের জন্য ১৫ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল। তবে তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকারা দাবি করেছেন যে যোগ্য প্রার্থীরা অযোগ্যদের সঙ্গে একসাথে শাস্তি পেয়েছেন, যা অন্যায়। অনেক চাকরিহারা ব্যক্তি দাবি করছেন যে তারা মেধার ভিত্তিতেই চাকরি পেয়েছিলেন এবং কোনো দুর্নীতিতে জড়িত নন। তবে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে যে ওএমআর শিট না থাকায় সবাইকে আলাদা করা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এই রায় নিয়ে মতভেদ দেখা গেছে। বিজেপি এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার হয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি অবিচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।
আইনি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে রিভিউ পিটিশন খারিজ হলেও এখনও কিউরেটিভ পিটিশনের পথ খোলা থাকলেও সেখানেও সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যে এই মামলার সব দিক বিস্তারিত খতিয়ে দেখেছে এবং নিশ্চিত হয়েছে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাপক দুর্নীতিতে কলুষিত ছিল।
এদিকে নিয়োগ দুর্নীতির মূল হোতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিলেও তিনি এখনও অন্যান্য মামলায় জেলেই রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কেবল টাকা পাওয়ার অভিযোগ নয়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারচুপির মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযোগ রয়েছে।
এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সরকারি চাকরিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছে। আগামী দিনে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয় সেটাই হবে আসল পরীক্ষা।
চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য এখন একমাত্র উপায় হলো নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে যে ২০১৬ সালের প্যানেলে থাকা যোগ্য প্রার্থীরা নতুন পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। তবে দুর্নীতিতে জড়িত বলে চিহ্নিত প্রার্থীদের আবেদনের সুযোগ থাকবে না।