বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণ বার্ষিকীতে সিঙ্গুর মামলায় টাটার বিজয়: সুপ্রিম কোর্টের ৭৬৬ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ

পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের ঠিক এক বছর পূর্তিতে সিঙ্গুর কারখানা মামলায় টাটা মোটরসের পক্ষে বড় রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার বিচারপতি পি নরসিমহা ও বিচারপতি অতুল এস চান্দুরকরের বেঞ্চ রাজ্য সরকারের আবেদন খারিজ করে টাটা মোটরসকে ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ বহাল রেখেছে। গত বছরের ৮ আগস্ট ৮০ বছর বয়সে মারা যান বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের শেষ মুখ্যমন্ত্রী।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে রাজ্য সরকারকে কেবল ৭৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণই নয়, সেই সাথে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ১১ শতাংশ হারে সুদও দিতে হবে। মামলার খরচ বাবদ অতিরিক্ত ১ কোটি টাকাও আদায় করতে হবে রাজ্যকে। সব মিলিয়ে এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৩৫০ কোটি টাকা।

২০০৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উদ্যোগে সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো কারখানার জন্য প্রায় ১০০০ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তখনকার বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তীব্র কৃষক আন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালে টাটা গোষ্ঠী প্রকল্প গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলনই পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেয়।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষযাত্রা: সাধারণ মানুষের মতোই বিদায়।

শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখানো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্য সিঙ্গুর ছিল এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ” স্লোগান দিয়ে ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরেই তিনি সিঙ্গুরে গাড়ির কারখানার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এই প্রকল্পের বিরোধিতাই শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন একজন অসাধারণ রাজনীতিবিদ ও কবি। কলকাতার পাম অ্যাভিনিউয়ের দুই কামরার সরকারি ফ্ল্যাটে বসবাস করা এই নেতা মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও বিলাসিতার ধারে কাছে যাননি। ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণকারী বুদ্ধদেব ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইয়ের ছেলে। টানা পাঁচ দশক ধরে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা এই নেতা ২০২২ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান প্রত্যাখ্যান করে আলোচনায় এসেছিলেন।

সিঙ্গুর মামলার জটিলতা শুরু হয় ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই অধিগৃহীত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর টাটা মোটরস ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের (WBIDC) বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা দায়ের করে। সমস্যা সমাধানে সুপ্রিম কোর্ট তিন সদস্যের একটি সালিশি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।

২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর এই সালিশি ট্রাইব্যুনাল সর্বসম্মতভাবে টাটা মোটরসের পক্ষে রায় দেয়। ট্রাইব্যুনাল জানায়, সিঙ্গুরে অটোমোবাইল কারখানা স্থাপনে ব্যর্থতার জন্য রাজ্য সরকারকে ৭৬৫.৭২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। টাটা গোষ্ঠী ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে একটি বিবৃতিতে এই রায়ের কথা নিশ্চিত করে।

রাজ্য সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করে, কিন্তু সেখানে ব্যর্থ হয়। পরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে রাজ্য, যেখানে অভিযোগ করা হয় যে সালিশি কমিটির এক সদস্য টাটাদের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বালের দাবি অনুযায়ী, ওই বিচারপতি টাটা গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে ১৫ বার নাগপুর গিয়েছেন।

জমি অধিগ্রহণ, শিল্পায়নের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

টাটাদের আইনজীবী মুকুল রোহতগি এই অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করে রাজ্যকে জরিমানা করার দাবি জানান। সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যকে সতর্ক করে দিয়ে বলে যে অভিযোগ অযৌক্তিক প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাজ্যের আবেদন খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত।

এই রায়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিরোধীরা বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক স্বার্থে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফল আজ রাজ্যের করদাতাদের গুনতে হবে। অন্যদিকে শাসকদল বলছে, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষাই ছিল সেই সময়ের মূল লক্ষ্য।

সিঙ্গুর আন্দোলনের স্মৃতি এখনও জীবন্ত পশ্চিমবঙ্গে। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে সমর্থন জুগিয়েছিলেন অরুন্ধতী রায়, মহাশ্বেতা দেবী, মেধা পাটকরের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল যে কৃষকদের জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া যাবে না। সিঙ্গুরের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ও অগণিত ভক্তরা তাকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগেই চোখ ও দেহ দান করে গিয়েছিলেন, তাই কোনো শেষকৃত্য হয়নি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে বিদায় জানানো হয়েছিল।

দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় (সিওপিডি) ভুগছিলেন বুদ্ধদেব। অসুস্থতার কারণে শেষ কয়েক বছর কার্যত গৃহবন্দি ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কয়েকদিন ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রাখার পর বাড়িতে ফিরেছিলেন।

৮ আগস্ট ২০২৪ সকালে প্রাতঃরাশের পর চা খেয়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধদেব। তাকে নেবুলাইজার দেওয়ার চেষ্টা হলেও সেই সময়েই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়।

এদিকে সিঙ্গুর বিতর্ক অতীত হলেও টাটা গ্রুপ পশ্চিমবঙ্গে আবার বিনিয়োগ শুরু করেছে। রাজ্যে কয়েকশো কোটি টাকা বিনিয়োগ করে নতুন কারখানায় কাজ শুরু করেছে টাটা গ্রুপ। এতে প্রমাণিত হয় যে শিল্পপতিরা রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে ব্যবসার সুযোগ খোঁজেন।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর আগামী ১২ আগস্ট কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি অনিরুদ্ধ রায়ের বেঞ্চে এই মামলার পরবর্তী শুনানি রয়েছে। এই শুনানিতে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের বিষয়ে আরও স্পষ্টতা আসতে পারে।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের ঠিক এক বছর পূর্তিতে সিঙ্গুর মামলার এই রায় যেন এক যুগের অবসান ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা নির্দেশ করছে। একদিকে যেমন একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদের স্মৃতি, অন্যদিকে তেমনি শিল্পায়নের জটিল চ্যালেঞ্জের বাস্তবতা – দুটোই মিলেমিশে আছে আজকের এই ঘটনায়।

Share This Article