How to reduce cancer risk : বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার একটি প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হলেও, আশার কথা হল যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৩০-৫০% ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে আমরা আজই ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারি। এই ব্লগে আমরা জানব, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে আজই কোন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এবং কীভাবে সেগুলো আমাদের দীর্ঘকালীন স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস: ক্যান্সার প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ক্যান্সার প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস যেভাবে আমাদের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, তেমনি ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়াতে বা কমাতে পারে। মেয়ো ক্লিনিকের গবেষণা অনুযায়ী, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
উদ্ভিজ্জ খাবারের গুরুত্ব
প্রতিদিনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে ফল ও শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। উদ্ভিজ্জ খাবার যেমন ফল, শাকসবজি, সম্পূর্ণ শস্য এবং ডাল ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই খাবারগুলোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান কোষকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে এবং ক্যান্সারের বিকাশ রোধ করতে সাহায্য করে।
মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট
গবেষণা দেখিয়েছে যে, মেডিটেরেনিয়ান ডায়েটে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে। এই খাদ্যাভ্যাসে উদ্ভিজ্জ খাবার, সম্পূর্ণ শস্য, ডাল এবং বাদাম বেশি পরিমাণে থাকে। মাখন বা অন্যান্য প্রাণিজ চর্বির পরিবর্তে অলিভ অয়েল এবং লাল মাংসের পরিবর্তে মাছ বেশি খাওয়া হয়।
কম খেতে হবে এমন খাবার
লাল মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত, কারণ এগুলো কোলন ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া, সম্পৃক্ত চর্বি, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত ক্যালোরি এবং চিনিযুক্ত খাবার সীমিত করা উচিত।
আজই করণীয়
আজই আপনার খাবারের তালিকা পুনর্বিবেচনা করুন। প্রতিদিনের খাবারে অন্তত ৫ সার্ভিং ফল ও শাকসবজি যোগ করুন। লাল মাংসের পরিবর্তে মাছ, মুরগি, বা উদ্ভিজ্জ প্রোটিন (যেমন ডাল, টোফু) বেছে নিন। প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং জাঙ্ক ফুড কম খান। এই ছোট পরিবর্তনগুলো আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
শারীরিক সক্রিয়তা ও স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা
শারীরিক সক্রিয়তা এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা ক্যান্সার প্রতিরোধের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সঠিক ওজন বজায় রাখা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর ওজনের প্রভাব
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখলে স্তন, অগ্ন্যাশয়, যকৃত, কোলন এবং কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। অতিরিক্ত ওজন থাকলে শরীরে এস্ট্রোজেন এবং ইনসুলিনের মাত্রা বাড়ে, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
নিয়মিত ব্যায়ামের উপকারিতা
শারীরিক সক্রিয়তা নিজেই স্তন ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ক্যান্সার রিসার্চ অনুযায়ী, ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম বা ৭৫ মিনিট তীব্র ব্যায়াম করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণের কৌশল
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার জন্য ক্যালোরি নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রক্রিয়াজাত খাবার সীমিত করা এবং প্রতিদিন কিছুটা শারীরিক সক্রিয়তা বজায় রাখা স্বাস্থ্যকর ওজন অর্জনে সাহায্য করে।
আজই করণীয়
আজই একটি ২০ মিনিটের হাঁটা শুরু করুন। সেটি বাড়ির চারপাশে, পার্কে, বা যেকোনো খোলা জায়গায় হতে পারে। সিঁড়ি ব্যবহার করুন, লিফটের পরিবর্তে। দীর্ঘ সময় বসে থাকা এড়ান – প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ৫ মিনিট উঠে হাঁটুন। এই ছোট পরিবর্তনগুলো আস্তে আস্তে আপনার জীবনধারায় শারীরিক সক্রিয়তা বাড়াবে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাবে।
তামাক ও অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা
তামাক বর্জন এবং অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা ক্যান্সার প্রতিরোধের তৃতীয় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এগুলো ক্যান্সারের সর্বাধিক পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
তামাকের প্রভাব
তামাক ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত। ধূমপান না করা ক্যান্সার প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তামাকে থাকা ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ আমাদের শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
অ্যালকোহলের ঝুঁকি
অ্যালকোহল সেবন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, যেমন স্তন, কোলন, ফুসফুস, কিডনি এবং যকৃতের ক্যান্সার। যত বেশি অ্যালকোহল সেবন করা হয়, ততই ঝুঁকি বাড়ে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির নির্দেশিকা অনুযায়ী, অ্যালকোহল এড়ানো সবচেয়ে ভালো।
অবিলম্বে ছাড়ার উপায়
ধূমপান ছাড়ার জন্য স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারদের সাহায্য নিন। নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, কাউন্সেলিং এবং অন্যান্য সমর্থন পরিষেবা ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করতে পারে। অ্যালকোহল সেবন সীমিত করার জন্য, পুরুষদের দিনে সর্বোচ্চ দুটি ড্রিংক এবং মহিলাদের একটি ড্রিংকের মধ্যে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় – তবে সম্পূর্ণ বর্জন করাই সর্বোত্তম।
আজই করণীয়
যদি আপনি ধূমপায়ী হন, আজই ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিন। একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং ধূমপান ছাড়ার পরিকল্পনা তৈরি করুন। অ্যালকোহল সেবন করেন? তাহলে ‘অ্যালকোহল-মুক্ত দিন’ রাখুন এবং আস্তে আস্তে সেবনের পরিমাণ কমাতে থাকুন। মনে রাখবেন, এই পরিবর্তনগুলো আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা
ত্বকের ক্যান্সার হল সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সারের একটি, এবং সৌভাগ্যবশত, এটি প্রতিরোধও সবচেয়ে সহজ। সূর্যের অতিবেগুনি (আলট্রাভায়োলেট) রশ্মি ত্বকের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
সূর্য থেকে সুরক্ষার উপায়
সূর্যের আলোয় অতিরিক্ত সময় কাটানো সীমিত করুন, বিশেষ করে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে, যখন সূর্যের রশ্মি সবচেয়ে শক্তিশালী থাকে। বাইরে যাওয়ার সময় সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, ছায়ায় থাকুন, এবং টুপি, সানগ্লাস এবং আস্তিন-সহ পোশাক পরুন।
আজই করণীয়
আজই একটি উচ্চ SPF (কমপক্ষে ৩০) সানস্ক্রিন কিনুন এবং প্রতিদিন ব্যবহার করার অভ্যাস তৈরি করুন, এমনকি মেঘলা দিনেও। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন লাগান এবং দিনের মধ্যে আবার লাগানোর কথা মনে রাখুন। একটি সুরক্ষামূলক টুপি বা ছাতা সাথে রাখুন, যাতে সূর্যের সরাসরি আলো থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্ক্রীনিং
ক্যান্সার প্রতিরোধে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্ক্রীনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগাম শনাক্তকরণ ক্যান্সারের সফল চিকিৎসার চাবিকাঠি।
নিয়মিত স্ক্রীনিং টেস্টের গুরুত্ব
স্ক্রীনিং টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্সারগুলি আগে শনাক্ত করতে সাহায্য করে যখন সেগুলি চিকিৎসাযোগ্য থাকে। উদাহরণস্বরূপ, নিয়মিত সিগময়ডোস্কোপি কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ২৫% কমাতে পারে, এবং এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমাতে পারে।
আজই করণীয়
আপনার বয়স, লিঙ্গ এবং পারিবারিক ইতিহাস অনুযায়ী কোন ক্যান্সার স্ক্রীনিং টেস্ট প্রয়োজন তা জানতে আপনার ডাক্তারের সাথে আজই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন। সাধারণ স্ক্রীনিং টেস্টের মধ্যে রয়েছে ম্যামোগ্রাম (স্তন ক্যান্সারের জন্য), কোলোনোস্কোপি (কোলন ক্যান্সারের জন্য), এবং প্যাপ স্মিয়ার (সার্ভিকাল ক্যান্সারের জন্য)। নিয়মিত চেকআপের একটি সময়সূচী তৈরি করুন এবং তা অনুসরণ করুন।
ক্যান্সার প্রতিরোধে পরিসংখ্যান এবং তথ্য
ক্যান্সার থেকে সুরক্ষার জন্য পরিসংখ্যান এবং তথ্য জানা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে।
বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের অবস্থান
২০২১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে ১,৭৭৭,৫৬৬টি নতুন ক্যান্সার ক্ষেত্র রিপোর্ট করা হয়েছিল এবং ২০২২ সালে ৬০৮,৩৬৬ জন ক্যান্সারে মারা গেছেন। ২০২৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১,৯৫৮,৩১০টি নতুন ক্যান্সার ক্ষেত্র এবং ৬০৯,৮২০টি ক্যান্সারে মৃত্যুর প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল।
ক্যান্সার প্রতিরোধের সম্ভাবনা
হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথের বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে আমেরিকার ক্যান্সার মৃত্যুর ৭৫% পর্যন্ত প্রতিরোধ করা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৩০-৫০% ক্যান্সার ঝুঁকি কারণগুলি এড়িয়ে এবং প্রমাণিত প্রতিরোধমূলক কৌশলগুলি প্রয়োগ করে প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
প্রভাবশালী তথ্য
২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত, পুরুষদের মধ্যে ক্যান্সারের মৃত্যুর হার প্রতি বছর ২.৩% কমেছে এবং নারীদের মধ্যে প্রতি বছর ১.৯% কমেছে। এই পরিসংখ্যান দেখায় যে ক্যান্সার প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে, তবে এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এর শুরু হতে পারে আজকে নেওয়া সহজ পদক্ষেপগুলি থেকে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা, শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো এবং তামাক ও অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা – এই তিনটি সহজ পরিবর্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
মনে রাখবেন, ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য কখনোই দেরি হয় না। ৩০-৫০% ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য হওয়া আশাব্যঞ্জক। আজ থেকেই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন, তামাক এড়িয়ে চলুন, অ্যালকোহল সীমিত করুন, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সুরক্ষা নিন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান।
এই ছোট পরিবর্তনগুলি আপনার জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো শুধু সম্ভব নয়, এটি আপনার সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতাও উন্নত করবে। আজই শুরু করুন, আপনার স্বাস্থ্যের নিয়ন্ত্রণ নিন।