Tamarind and jaggery drink benefits: তেঁতুল-গুড়ের শরবত হল এমন একটি পানীয় যা শুধু টক-মিষ্টি স্বাদেই নয়, স্বাস্থ্য উপকারিতার বিবেচনাতেও অতুলনীয়। গরমের দিনে শরীরে স্বস্তি দেওয়া থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো পর্যন্ত অনেক গুণে ভরপুর এই প্রাকৃতিক পানীয়টি। তেঁতুলের টক স্বাদ আর গুড়ের মিষ্টি স্বাদের সম্মিলনে তৈরি এই শরবত শরীরের নানা সমস্যার সমাধান দিতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আসুন জেনে নেই এই অমৃত পানীয়ের বিস্তারিত তথ্য।
তেঁতুল-গুড়ের শরবত: এক অনন্য পানীয়
তেঁতুল বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম পরিচিত ফল, যা শুধু মশলা হিসেবেই নয়, ঔষধি গুণেও সমৃদ্ধ। আমাদের রান্নাঘরে নিত্য ব্যবহার্য এই ফলটি কাঁচা অবস্থায় টক, কিন্তু পাকলে মিষ্টি হয়ে ওঠে। তেঁতুলের এই স্বাদের সাথে গুড়ের প্রাকৃতিক মিষ্টিত্ব যোগ করে যখন শরবত তৈরি করা হয়, তখন এটি শুধু স্বাদেই নয়, গুণেও হয়ে ওঠে অনবদ্য।
প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে তেঁতুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের দাদি-নানীরা গরমের দিনে তেঁতুলের শরবত খেতেন শরীর ঠান্ডা রাখতে এবং বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পেতে। বর্তমানে বিজ্ঞানও স্বীকার করে যে, তেঁতুল আসলেই অনেক রোগের প্রতিকার হিসেবে কাজ করতে পারে।
তেঁতুল-গুড়ের শরবতের পুষ্টিগুণ
তেঁতুল পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তেঁতুলে রয়েছে অসংখ্য পুষ্টি উপাদান। একনজরে দেখে নিই:
-
মোট খনিজ পদার্থ: ২.৯ গ্রাম
-
খাদ্যশক্তি: ২৮৩ কিলোক্যালোরি
-
আমিষ: ৩.১ গ্রাম
-
চর্বি: ০.১ গ্রাম (অত্যন্ত কম)
-
শর্করা: ৬৬.৪ গ্রাম
-
ক্যালসিয়াম: ১৭০ মিলিগ্রাম
-
আয়রন: ১০.৯ মিলিগ্রাম
-
ক্যারোটিন: ৬০ মাইক্রোগ্রাম
-
ভিটামিন সি: ৩ মিলিগ্রাম
অন্যদিকে গুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ। তেঁতুল এবং গুড়ের এই মিলন শরীরের জন্য একটি পুষ্টিকর সমন্বয় তৈরি করে।
তেঁতুল-গুড়ের শরবতের স্বাস্থ্য উপকারিতা
তেঁতুল-গুড়ের শরবতের নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। দেখে নেওয়া যাক কেন এটি আপনার খাদ্যতালিকায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে:
হজমে সহায়তা
তেঁতুলে থাকা ডায়াটারি ফাইবার হজমে সাহায্য করে। বিশেষ করে গরমের দিনে অনেকেই বদহজমের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এক কাপ জলে তেঁতুল ভিজিয়ে সামান্য নুন, চিনি বা গুড় মিশিয়ে খেলে বদহজমের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব3। এছাড়া, তেঁতুল পেটে গ্যাসের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে এবং পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
ওজন কমাতে সহায়তা
তেঁতুলে হাইড্রক্সিসাইট্রিক অ্যাসিড রয়েছে, যা শরীরে চর্বি জমতে দেয় না। এই অ্যাসিড সেরোটোনিন নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বাড়িয়ে খিদে কমায়। ফলে খাবারে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ আসে এবং ওজন বৃদ্ধি রোধ হয়। তেঁতুল ফাইবার সমৃদ্ধ ও কম চর্বিযুক্ত হওয়ায় ওজন কমাতেও সাহায্য করে। এটি ফ্ল্যাভোনয়েড ও পলিফেনল সমৃদ্ধ, যা বিপাকক্রিয়া বাড়ায় ও মেদবহুলতা কমাতে সহায়তা করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
তেঁতুলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময় ঠান্ডা লাগা এবং সর্দি-কাশি থেকে রেহাই পেতে গরম জলে তেঁতুল আর গোলমরিচ মিশিয়ে খেলে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। তেঁতুলের প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য শরীরের হৃদরোগ, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসের মতো রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ
তেঁতুল রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড ও প্লাজমা কোলেস্টেরল যেমন, এলডিএল কমিয়ে রক্তনালিতে প্লাগ তৈরি হতে বাধা দেয় এবং এথেরোক্লেরোসিস নামক রোগের প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি লিভারে ফ্যাট জমা হওয়ার প্রবণতাকেও কমায়। তেঁতুলে থাকা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এ কারণে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তারা তেঁতুলের জুস বানিয়ে খেতে পারেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
তেঁতুলের বীজ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এছাড়া এটি রক্তে চিনির মাত্রাও ঠিক রাখে। বিভিন্ন ফাইটোক্যামিকেল থাকার কারণে তেঁতুল শরীরের রক্তের গ্লুকোজ কমাতে ভূমিকা রাখে। ডায়াবেটিস রোগীদের হাইপারগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যাওয়া প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
গরমের দিনে রোদে ঘুরে এসে তেঁতুলের টক-মিষ্টি সরবত খেলে শরীর তৎক্ষণাৎ ঠান্ডা হয় এবং স্বস্তি পাওয়া যায়। এটি শরীরের অতিরিক্ত তাপ কমাতে সাহায্য করে এবং হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এই পানীয় শরীরকে সতেজ রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
তেঁতুল-গুড়ের শরবত তৈরির সহজ পদ্ধতি
আপনার নিজের রসনার স্বাদ অনুযায়ী বাড়িতে খুব সহজেই তেঁতুল-গুড়ের শরবত তৈরি করতে পারেন। চলুন দেখে নেওয়া যাক কিভাবে:
উপকরণ:
-
বেশ খানিকটা তেঁতুল (প্রায় ১০০ গ্রাম)
-
গুড় (স্বাদমতো)
-
ভাজা জিরে গুঁড়ো (১ চা চামচ)
-
শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো (অল্প পরিমাণে)
-
বিট লবণ (স্বাদমতো)
-
গোলমরিচের গুঁড়ো (১/২ চা চামচ)
-
মধু (১ চা চামচ, ঐচ্ছিক)
-
পুদিনা পাতা (সাজানোর জন্য)
-
বরফ
প্রস্তুত প্রণালী:
-
তেঁতুল জলে ভিজিয়ে রাখুন কয়েক ঘন্টা।
-
তেঁতুল নরম হয়ে গেলে হাত দিয়ে ভালোভাবে মেখে ক্বাথ বের করে নিন।
-
একটি গ্লাসে দু’চামচ তেঁতুলের ক্বাথ, ভাজা জিরে গুঁড়ো, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, বিটলবণ, গোলমরিচের গুঁড়ো আর গুড় ভাল করে মিশিয়ে ঠাণ্ডা জল দিয়ে নিন।
-
বরফ আর পুদিনা পাতা দিয়ে পরিবেশন করুন তেঁতুলের শরবত।
এই শরবতের স্বাদ বাড়াতে চাইলে গুড়ের পরিমাণ বাড়াতে পারেন। গুড়ের প্রাকৃতিক মিষ্টি পানীয়টিকে আরও স্বাদযুক্ত করবে এবং অতিরিক্ত পুষ্টি যোগ করবে।
তেঁতুল-গুড়ের শরবত খাওয়ার সতর্কতা
তেঁতুল-গুড়ের শরবত যেমন উপকারী, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে এর অপকারিতাও রয়েছে। সেগুলি জেনে নেওয়া উচিত:
-
অতিরিক্ত সেবন করবেন না: তেঁতুলের অনেক উপকারিতা থাকলেও একটানা প্রতিদিন খাওয়া উচিত নয়। কিছুদিন পরপর বা স্বাদের পরিবর্তনের জন্য এ ফলটি খেতে পারেন1। অতিরিক্ত তেঁতুল খেলে শরীর অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
-
ওষুধের সাথে সতর্কতা: বিভিন্ন ওষুধ যারা গ্রহণ করেন তারা তেঁতুল খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। নন-স্টেরয়ডাল, অ্যান্টিফ্লামেটরি, রক্ত পাতলা করার ওষুধ, অ্যান্টি প্লাটিলেট ওষুধের সঙ্গে তেঁতুল না খাওয়াই ভালো।
-
রক্তচাপ কমে যাওয়া: বেশি তেঁতুল খেলে রক্তের চাপ কমে যেতে পারে। যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কম, তাদের তেঁতুল খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
-
কিডনি সমস্যা: কিডনির সমস্যা থাকলে তেঁতুলের জুস খাওয়া উচিত না। এতে কিডনি রোগীদের পটাশিয়ামের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে।
-
অতিরিক্ত অম্লীয়তা: তেঁতুল টক জাতীয় ফল হওয়ায় অম্লীয়। যাদের গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বা অ্যাসিডিটি আছে, তাদের জন্য বেশি পরিমাণে তেঁতুল খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে।
কারা তেঁতুল-গুড়ের শরবত এড়িয়ে চলবেন
নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের তেঁতুল-গুড়ের শরবত পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত:
-
কিডনি রোগী: তেঁতুলে উচ্চ মাত্রার পটাশিয়াম থাকে, যা কিডনি রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
-
অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ওষুধ সেবনকারী: তেঁতুলের এন্টিকোয়াগুলেন্ট এবং এন্টিপ্লেটলেট ফাংশন আছে। যার ফলে এটি ব্লাড থিনার হিসাবে কাজ করতে পারে। যারা ইতিমধ্যেই রক্ত পাতলা করার ওষুধ খান, তাদের জন্য অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
-
নিম্ন রক্তচাপের রোগী: তেঁতুল রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। যাদের রক্তচাপ আগে থেকেই কম, তাদের জন্য তেঁতুল খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
-
গর্ভবতী মহিলা: যদিও তেঁতুল গর্ভবতী মহিলাদের মর্নিং সিকনেস কমাতে সাহায্য করে, তবুও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
কুসংস্কার: তেঁতুল খেলে কি রক্ত পানি হয়ে যায়?
অনেকে বিশ্বাস করেন তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায়। কিন্তু পুষ্টিবিদ স্বর্ণালী দাস বিজয়া বলেন, “তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায় কথাটি কুসংস্কার মাত্র”।
তেঁতুলের এন্টিকোয়াগুলেন্ট এবং এন্টিপ্লেটলেট ফাংশন আছে, যার ফলে এটি ব্লাড থিনার হিসেবে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ রক্তের ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রক্তের ঘনত্ব কমানো আর রক্ত পানি হয়ে যাওয়া একেবারেই ভিন্ন বিষয়। রক্তের পিএইচের মান কমে পানির পিএইচ মানের সমান হলেই রক্ত পানির মতো হতে পারে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় ঘটার সম্ভাবনা নেই। কারণ রক্তের বাফার সিস্টেম রক্তের পিএইচ মান স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে। শরীর মারাত্মকভাবে রোগাক্রান্ত না হলে রক্তের পিএইচ মানের তারতম্য ঘটার ঝুঁকি কম।
তেঁতুল-গুড়ের শরবত একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর পানীয় যা শুধু স্বাদেই নয়, উপকারিতার দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হজমে সহায়তা, ওজন কমানো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এই পানীয়টি অসামান্য ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে গরমের দিনে এটি শরীরকে ঠান্ডা ও সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
তবে, অন্যান্য খাবারের মতো, তেঁতুল-গুড়ের শরবতও সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। কিডনি রোগ, নিম্ন রক্তচাপ, বা রক্ত পাতলা করার ওষুধ সেবনকারীদের এই পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত। সর্বোত্তম ফল পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এই পানীয় গ্রহণ করুন।
সুতরাং, তেঁতুল-গুড়ের শরবতের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন থেকে এটি পান করুন এবং এর স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলি উপভোগ করুন। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এই পানীয়টি আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অবদান রাখবে, তবে সবকিছুর মতো, এক্ষেত্রেও মাত্রা বজায় রাখাই বিজ্ঞতার পরিচয়।