গতকাল বৃহস্পতিবার (১৫ মে, ২০২৫) সল্টলেকের বিকাশ ভবনে চাকরিহারা শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে পুলিশি বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে বিকাশ ভবনের সামনে জমায়েত হয়েছিলেন। রাত ৮টা নাগাদ হঠাৎ করেই আন্দোলনস্থলে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং আন্দোলনকারী শিক্ষকদের উপর লাঠিচার্জ চালিয়ে হিঁচড়ে-টেনে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় অনেক শিক্ষক আহত হয়েছেন এবং রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। চাকরিহারা শিক্ষকদের এই নিষ্ঠুর দমনে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলনের পটভূমি
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (WBSSC) দ্বারা নিযুক্ত ২৫,৭৫২ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। এপ্রিল মাসে সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের আদেশ বহাল রেখে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে এই পদগুলি বাতিল করে। সুপ্রিম কোর্ট বাতিল নিয়োগগুলি নতুন করে পূরণ করতে মমতা ব্যানার্জী সরকারকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত সময় দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, চাকরিহারা শিক্ষকদের একটি বড় অংশ দাবি করছেন যে তারা ‘যোগ্য’ প্রার্থী ছিলেন এবং নিজেদের প্রমাণ করেই চাকরি পেয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য, তারা কোনো দুর্নীতির সাথে যুক্ত নন এবং চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য নতুন করে কোনো পরীক্ষা দিতে রাজি নন। শিক্ষকরা দাবি করছেন, সরকারকেই দুর্নীতিগ্রস্ত (‘tainted’) এবং অদুর্নীতিগ্রস্ত (‘untainted’) শিক্ষকদের আলাদা করে তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং যোগ্য শিক্ষকদের স্বপদে পুনর্বহাল করতে হবে।
বিকাশ ভবনে যা ঘটেছিল
১৫ মে দুপুর ১২টা নাগাদ বিকাশ ভবনের সামনে ‘যোগ্য’ শিক্ষক-শিক্ষিকারা জমায়েত হতে শুরু করেন। প্রতিবাদকারীদের অভিযোগ, সকাল থেকেই বিকাশ ভবনের ভিতরে প্রায় শতাধিক কর্মী আটকে পড়েছিলেন। আন্দোলনকারীরা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, পরীক্ষা ছাড়াই তাদের চাকরি ফেরানোর বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতি না দিলে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন না। ততক্ষণ পর্যন্ত বিকাশ ভবন ঘেরাও করে আন্দোলন চলবে বলে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
দিনের একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের মূল ফটক ভেঙে ফেলেন এবং কেউ কেউ ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়েন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, ভবনের আটকে পড়া কর্মী বা আধিকারিকদের জন্য খাবার বা জল সরবরাহে কোনো বাধা দেওয়া হবে না।
রাতের আক্রমণ
রাত ৮টা নাগাদ হঠাৎ করেই আন্দোলনস্থলে পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পুলিশ জোর করে আন্দোলনকারীদের সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশকে আসতে দেখে অনেক আন্দোলনকারী রাস্তায় শুয়ে পড়েন, কিন্তু তাতেও পুলিশ থামেনি। তারা টেনে-হিঁচড়ে বিক্ষোভকারী চাকরিহারা শিক্ষকদের সরিয়ে নিয়ে যায় এবং লাঠিচার্জ শুরু করে।
পুলিশের এই আক্রমণে অনেক শিক্ষক আহত হয়েছেন, কাউকে কাউকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। অন্যদিকে পুলিশের অভিযোগ, সকাল থেকেই চাকরিহারা আন্দোলনকারীদের ভিড়ে নকশালপন্থীরা সামিল ছিলেন, যারা রাতে সুপরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালায়।
তৃণমূলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিকাশ ভবনে আন্দোলনের সময় বিধাননগর পুরনিগমের চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত বিক্ষোভস্থলে পৌঁছলে আন্দোলনকারীরা তাকে ঘিরে ‘চোর চোর’ স্লোগান দেন। কিছু শিক্ষকদের অভিযোগ, সকালে সব্যসাচী দত্তের লোকজন হেলমেট দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের মেরেছে।
আরও উল্লেখযোগ্য যে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতরেও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। শাসকদলেরই একজন তারকা সাংসদ এই ঘটনাকে “দুর্ভাগ্যজনক” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছেন, “চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন পুলিশ দিয়ে দমাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরা তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতির শিকার।” বিরোধী দলগুলি শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের উপর সরকারের নির্দেশে পুলিশের “নৃশংস হামলার” প্রতিবাদে সবাইকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছে।
শিক্ষক আন্দোলনের জেলা ছড়িয়ে পড়া
শুধু কলকাতাতেই নয়, এই আন্দোলন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। মেদিনীপুর, মালদা, পূর্ব বর্ধমান, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং বালুরঘাটে ডিআই অফিসের সামনেও বিক্ষোভ দেখা গেছে। চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা সেখানেও একই দাবি তুলেছেন – যোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা এবং তাদের পুনর্বহাল করা।
এপ্রিল মাসেও দক্ষিণ কলকাতার কাসবায় জেলা পরিদর্শকের কার্যালয়ে অনুরূপ আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা ঘটেছিল, যেখানে পুলিশ দাবি করেছিল যে আন্দোলনকারীরা প্রথমে আক্রমণ করেছিল। সেই ঘটনায় ছয় পুলিশ কর্মী, যার মধ্যে দুজন মহিলা, আহত হন বলে পুলিশ কমিশনার মনোজ ভার্মা জানিয়েছিলেন।
সরকারি অবস্থান
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আগেই চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে তাদের চাকরি নিরাপদ। তিনি বলেছিলেন, “কেউ যোগ্য শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারবে না। আমি যতদিন আছি, যোগ্য শিক্ষকরা তাদের কর্মস্থান হারাবেন না।”
রাজ্য সরকার এপ্রিল ৭ তারিখে সুপ্রিম কোর্টে একটি পুনর্বিবেচনা আবেদন দায়ের করেছে। মুখ্যসচিব মনোজ পন্ত জানিয়েছেন যে তারা সুপ্রিম কোর্টের আদেশের সম্পর্কে স্পষ্টীকরণও চেয়েছেন এবং শীঘ্রই পুনর্বিবেচনা আবেদন দাখিল করবে।
দুর্নীতি কাণ্ড: প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও নেতাদের গ্রেপ্তার
এই নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন তৃণমূল বিধায়ক এবং শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাক্তন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন যে WBSSC দ্বারা নিযুক্ত দুর্নীতিগ্রস্ত (‘tainted’) এবং অদুর্নীতিগ্রস্ত (‘untainted’) শিক্ষকদের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব।
আন্দোলনকারীদের দাবি
আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিম্নলিখিত দাবিগুলি তুলে ধরেছেন:
- দুর্নীতিগ্রস্ত (‘tainted’) এবং অদুর্নীতিগ্রস্ত (‘untainted’) শিক্ষকদের আলাদা তালিকা প্রকাশ করতে হবে
- যোগ্য প্রার্থীদের স্বপদে পুনর্বহাল করতে হবে
- পুনরায় কোনো পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই
- মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হস্তক্ষেপ
আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি মেহবুব জানিয়েছেন, “আমরা আমাদের বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব। আমরা নতুন পরীক্ষায় বসব না এবং আমাদের চাকরি অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। একদিকে হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে রাজ্য সরকারের সামনে রয়েছে শীঘ্রই নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ।
সুপ্রিম কোর্টের বিভাগীয় বেঞ্চ এই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে মৌলিকভাবে ত্রুটিযুক্ত এবং অপূরণীয় বলে মন্তব্য করেছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
পুলিশের অ্যাকশন: টানাপোড়েন
পুলিশের অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের নাম করে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের দাবি, তারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিলেন, কিন্তু পুলিশ অযথাই লাঠিচার্জ করে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে।
সকাল থেকেই বিকাশ ভবনের সামনে প্রচুর পুলিশ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছিল, যা প্রমাণ করে সরকার আগে থেকেই আন্দোলন দমনের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
তৃণমূল কংগ্রেসের সংকট
এই ঘটনাক্রম তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করেছে। এক দিকে সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার চাপ, অন্যদিকে চাকরিহারা শিক্ষকদের ক্ষোভ এবং আন্দোলন। এছাড়া, পুলিশের লাঠিচার্জের ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা সরকারকে আক্রমণ করেছে এবং দলের নিজের ভিতরেও প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতি নিয়ে আগে থেকেই সমালোচনার মুখে মমতা ব্যানার্জি সরকার। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ দলের বেশ কয়েকজন নেতার গ্রেপ্তারি এবং এখন শিক্ষকদের উপর পুলিশি নির্যাতন সরকারের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
শেষকথা
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ এবং নির্যাতনের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা যেভাবে পুলিশি বর্বরতার শিকার হয়েছেন, তা গণতান্ত্রিক দেশে মেনে নেওয়া যায় না। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত সংযম প্রদর্শন করা, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসা এবং যোগ্য শিক্ষকদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি থেকেই যায় – শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করতে পুলিশি বলপ্রয়োগ কি তৃণমূল সরকারের শেষ সম্বল? হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষকের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনীতি করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সময়ই বলবে এই প্রশ্নের উত্তর।