পহেলগাঁও হামলার পর পাকিস্তানের ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করল ভারত

২০২৫ সালের ৭ মে ভোরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন Sindoor’ নামে একটি সুনির্দিষ্ট সামরিক অভিযান চালিয়ে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (PoK) ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে। এই অভিযান গত ২২ এপ্রিল পাহলগামে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয়, যেখানে ২৬ জন নিরীহ পর্যটক ও স্থানীয় লোক নিহত হয়েছিলেন। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর যৌথ অভিযানে জৈশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার প্রধান ঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট আক্রমণ চালানো হয়।

Operation Sindoor-এর লক্ষ্যবস্তু এবং অবস্থান

ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের (PoK) মোট ৯টি স্থানে আক্রমণ চালিয়েছে। এর মধ্যে ৪টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এবং ৫টি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত। গোয়েন্দা সংস্থা RAW সমস্ত লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার পর পরিকল্পিতভাবে জৈশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার ঘাঁটিগুলিতে আক্রমণ চালানো হয়।

পাকিস্তানে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুগুলি:

  • বাহাওয়ালপুর: জৈশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তর

  • মুরিদকে: লস্কর-ই-তৈবার সদর দপ্তর

  • সিয়ালকোট

  • অন্যান্য সন্ত্রাসী ঘাঁটি

পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুগুলি:

  • গুলপুর

  • ভিমবার

  • চাক আমরু

  • বাঘ

  • কোটলি

  • মুজাফ্ফারাবাদ

পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত জৈশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তর ১৯৯৯ সাল থেকেই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আজহারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। মাসুদ আজহার জাতিসংঘ-ঘোষিত একজন সন্ত্রাসী নেতা যিনি বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত।

অপারেশন Sindoor-এর পেছনের কারণ

২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পাহলগামে সংঘটিত ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিরপরাধ ব্যক্তি, যাদের অধিকাংশই পর্যটক ছিলেন, নিহত হন। এই ঘটনার পর থেকেই ভারত সরকার এর যথাযথ জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বিভিন্ন সময়ে পাহলগাম হামলার শক্ত জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিক্রিয়া নির্ধারণের জন্য “পূর্ণ অপারেশনাল স্বাধীনতা” প্রদান করেছিলেন। এর পাশাপাশি, ভারত ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায়।

অপারেশন Sindoor কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল

অপারেশন Sindoor ভারতীয় সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর যৌথ অভিযান হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল। সূত্র অনুসারে, রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়েছিল, যেখানে স্কাল্প ক্রুজ মিসাইল এবং হ্যামার সুনির্দিষ্ট-নির্দেশিত অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর সম্পদও এই অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছিল।

অপারেশনের বিবরণ:

  • সামরিক অভিযানটি ৭ মে ভোরে রাত ১:৪৪-এ চালানো হয়েছিল

  • গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলির সঠিক স্থানাঙ্ক প্রদান করেছিল

  • সুনির্দিষ্ট অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করা হয়েছিল

  • কামিকাজে ড্রোন (লয়টারিং অ্যামিউনিশন নামেও পরিচিত) ব্যবহার করা হয়েছিল, যা যন্ত্রে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল

  • প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সারারাত অপারেশন পর্যবেক্ষণ করেছিলেন

ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক একটি বিবৃতিতে বলেছে যে অপারেশনটি “ফোকাসড, মেজার্ড এবং নন-এস্কালেটরি” প্রকৃতির ছিল। তারা আরও উল্লেখ করেছে যে “কোনো পাকিস্তানি সামরিক সুবিধা লক্ষ্য করা হয়নি” এবং “ভারত লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন এবং সম্পাদনের পদ্ধতিতে যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছে”।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বর্তমান পরিস্থিতি

অপারেশন Sindoor-এর পরে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিওর সাথে কথা বলে অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিও একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে তারা ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

পাকিস্তান এই আক্রমণের নিন্দা করেছে। ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস এর মহাপরিচালক, লে. জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী বলেছেন যে ভারত ৬টি স্থানে মোট ২৪টি আঘাত হেনেছে, যাতে ৮ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হয়েছে।

অপারেশনের প্রভাব:

  • জম্মু-কাশ্মীরে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে

  • সেনা বিমান শ্রীনগর এবং কাশ্মীর উপত্যকায় টহল দিচ্ছে

  • ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে

বিমান চলাচলে প্রভাব

অপারেশন Sindoor-এর ফলে উত্তর ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিমান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। স্পাইসজেট জানিয়েছে যে ধর্মশালা, লেহ, জম্মু, শ্রীনগর এবং অমৃতসর বিমানবন্দর পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে যে জম্মু, শ্রীনগর, লেহ, জোধপুর, অমৃতসর, ভুজ, জামনগর, চণ্ডীগড় এবং রাজকোট থেকে সমস্ত ফ্লাইট ৭ মে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে।

ইন্ডিগো বিমান সংস্থা জানিয়েছে যে অঞ্চলে বায়ুসীমার পরিবর্তনের কারণে শ্রীনগর, জম্মু, অমৃতসর, লেহ, চণ্ডীগড় এবং ধর্মশালা থেকে আসা-যাওয়ার ফ্লাইটগুলি প্রভাবিত হয়েছে। বিকানের থেকে আসা-যাওয়ার ফ্লাইটগুলিও বর্তমান বায়ুসীমা বিধিনিষেধের কারণে প্রভাবিত হয়েছে।

ভারত সরকারের পদক্ষেপ

অপারেশন Sindoor-এর পরে, কেবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (CCS) সকাল ১১টায় নির্ধারিত কেবিনেট মিটিংয়ের আগে বৈঠক করবে। সূত্র অনুসারে, সরকার একটি সর্বদলীয় বৈঠকও ডাকবে।

অপারেশন Sindoor-এর বিস্তারিত ব্রিফিং পরে হবে বলে সেনাবাহিনী জানিয়েছে। ভারত সরকার বিভিন্ন দেশ, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকে অবহিত করেছে।

অপারেশন Sindoor পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থান প্রদর্শন করেছে। ২২ এপ্রিল পাহলগামে ২৬ জনের মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ৯টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে সুনির্দিষ্ট আক্রমণ চালিয়েছে। এই অপারেশনে জৈশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈবার মত সন্ত্রাসী সংগঠনের সদর দপ্তর লক্ষ্য করা হয়েছিল।

ভারত সরকার বারবার উল্লেখ করেছে যে অপারেশনটি সীমিত এবং সুনির্দিষ্ট ছিল, যেখানে শুধুমাত্র সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলিকে লক্ষ্য করা হয়েছিল, পাকিস্তানি সামরিক ইনস্টলেশন নয়। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় উভয় দেশের সশস্ত্র বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

Operation Sindoor ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষমতার একটি শক্তিশালী প্রদর্শন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের শূন্য সহনশীলতার নীতির আরেকটি প্রমাণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ভারত উভয়ই এখন পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং আশা করা হচ্ছে যে উত্তেজনা দ্রুত কমে যাবে।

 

Share This Article