প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমস্টেক (BIMSTEC) সম্মেলনের সাইডলাইনে আয়োজিত নৈশভোজে একসাথে বসেছিলেন। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়েতোংতার্ন শিনাওয়াত্রার আমন্ত্রণে চাও ফ্রায়া নদীর তীরে অবস্থিত শাংরি-লা হোটেলে আয়োজিত এই ডিনারে দুই নেতা পাশাপাশি বসেছিলেন।
নৈশভোজে মোদি, ইউনূস এবং নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি একসাথে বসেছিলেন। এটি গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই নেতার প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎকার। গত আট মাসে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই সাক্ষাৎ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সূত্র জানাচ্ছে, শুক্রবার (৪ এপ্রিল, ২০২৫) বিমস্টেক সম্মেলনের সাইডলাইনে মোদি এবং ইউনূসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এই বৈঠকের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছিল, যদিও প্রথমে মোদির সময়সূচিতে এই বৈঠকের উল্লেখ ছিল না। “আমাদের দিক থেকে আমরা বৈঠকের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। এখন আমরা ভারতের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া অপেক্ষা করছি,” বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান বুধবার জানিয়েছিলেন যে, “আমরা ভারতকে (দুই দেশের নেতাদের মধ্যে) এই আলোচনা হওয়ার অনুরোধ করেছি… এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে”। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের মতে, শুক্রবার দুপুরে বিমস্টেক সম্মেলনের ঠিক পরেই দুই নেতার মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এই সম্ভাব্য বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর হিংসাত্মক আক্রমণ এবং চরমপন্থী ইসলামি শক্তির উত্থান নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ক্রমাগত বাড়ছে। এছাড়া, ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তও দুই দেশের সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে।
সম্প্রতি ইউনূসের চীন সফর এবং সেখানে তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা নিয়েও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ইউনূস বলেছিলেন, “ভারতের পূর্ব অংশে সাতটি রাজ্য, যাদের ‘সেভেন সিস্টার্স’ বলা হয়, স্থলবেষ্টিত অঞ্চল। তাদের সমুদ্রে পৌঁছানোর কোন পথ নেই।” তিনি বাংলাদেশকে অঞ্চলে “সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন যে এটি চীনের অর্থনীতির সম্প্রসারণের একটি বিশাল সুযোগ হতে পারে।
ইউনূসের এই মন্তব্য ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, যারা এটিকে “লজ্জাজনক” এবং “উস্কানিমূলক” বলে আখ্যায়িত করেছেন। খলিলুর রহমান অবশ্য দাবি করেছেন যে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “তিনি সদিচ্ছা নিয়ে এই বক্তব্য দিয়েছিলেন। যদি লোকেরা এটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে, আমরা তা রোধ করতে পারি না”।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী মোদি সম্প্রতি ২৬ মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় দিবস উপলক্ষে ইউনূসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি উভয় দেশের স্বার্থ ও উদ্বেগের প্রতি পারস্পরিক সংবেদনশীলতার গুরুত্ব উল্লেখ করেছিলেন। মোদি লিখেছিলেন, “আমরা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্য আমাদের সাধারণ আকাঙ্খা দ্বারা চালিত এবং পরস্পরের স্বার্থ ও উদ্বেগের প্রতি পারস্পরিক সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে এই অংশীদারিত্ব এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।
৬ষ্ঠ বিমস্টেক সম্মেলনটি ২০১৮ সালে নেপালের কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ৪র্থ বিমস্টেক সম্মেলনের পর নেতাদের প্রথম শারীরিক সম্মেলন। শেষ সম্মেলন ২০২২ সালের মার্চে কলম্বোতে ভার্চুয়াল আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবারের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার এবং ভুটানের বিমস্টেক নেতাদের সাথে সামুদ্রিক সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন।
বিমস্টেক সম্মেলনের সাইডলাইনে শুক্রবার মোদি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি এবং মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল মিন আং হ্লাইংয়ের সাথেও বৈঠক করার সম্ভাবনা রয়েছে। মিয়ানমারের সাথে বৈঠক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশটি সম্প্রতি বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ভারত ‘অপারেশন ব্রহ্ম’ এর অধীনে ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তা করছে।
শুক্রবার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিমস্টেক এর চেয়ারম্যানশিপ হস্তান্তর করা হবে। এই প্রেক্ষাপটে মোদি-ইউনূস বৈঠক আঞ্চলিক সম্পর্কের দিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে।