নিমকাঠের দিব্য রূপ: দিঘায় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার অনাবিষ্কৃত কাহিনী

পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় নির্মাণাধীন জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি নিমকাঠ দিয়ে তৈরি করা হবে, যা প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুরূপ এই মূর্তিগুলি পবিত্র নিমকাঠ থেকে নির্মিত…

Srijita Chattopadhay

 

পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় নির্মাণাধীন জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি নিমকাঠ দিয়ে তৈরি করা হবে, যা প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুরূপ এই মূর্তিগুলি পবিত্র নিমকাঠ থেকে নির্মিত হয়, যা ভক্তদের কাছে দারু ব্রহ্ম নামেও পরিচিত। প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মন্দির ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভক্তদের জন্য উন্মুক্ত হবে, যা দিঘার পর্যটন পরিমণ্ডলে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।

দিঘা শহরের আকাশ জুড়ে ৬৫ মিটার উঁচু এই মন্দিরটি রাজস্থান থেকে আনা লাল বেলেপাথর দিয়ে নির্মিত হবে। এর স্থাপত্য শৈলী পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হচ্ছে, যা বাংলা ও ওড়িশার স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি অপূর্ব সংমিশ্রণ হবে। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যা বালেশ্বর জেলার চন্দ্রনেশ্বর মন্দির থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণের পিছনে রয়েছে অনেক পৌরাণিক কাহিনী। সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনী অনুসারে, যখন শ্রীকৃষ্ণ গুজরাটের দ্বারকায় বাস করতেন, তখন একদিন ভেরাভালের কাছে এক ঘন জঙ্গলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জরা নামক এক শিকারী ভুলবশত কৃষ্ণের পা হরিণ মনে করে তীর দিয়ে আঘাত করে। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণ জরাকে বলেন যে তার পার্থিব জীবন শেষ হয়েছে। দুঃখিত জরা কৃষ্ণের দেহ সম্মানের সাথে দাহ করে।

দাহের পর ছাইয়ের মধ্যে একটি ছোট উজ্জ্বল ধাতুর টুকরো পাওয়া যায়, যা পুড়ছিল না। জরা সেটি একটি কাঠের তক্তার উপর রেখে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, যিনি শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন, স্বপ্নে নির্দেশ পান সেই নদীতে স্নান করতে। সেখানে তিনি সেই রহস্যময় বস্তু খুঁজে পান এবং প্রাসাদে নিয়ে আসেন। নারদ মুনি রাজাকে তিনটি দেবতা – কৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করতে বলেন।

অন্য এক কাহিনী অনুসারে, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীল পর্বতে (বর্তমান নীলগিরি) এক অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হন। সেখানে তিনি নীল মাধব নামে ভগবান বিষ্ণুর এক রূপকে স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায় দ্বারা পূজিত হতে দেখেন। কিন্তু রাজা পৌঁছানোর আগেই নীল মাধব অদৃশ্য হয়ে যান।

ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একটি পবিত্র নিম গাছ থেকে মূর্তি তৈরি করার আদেশ দেন। কাহিনী অনুসারে, দিব্য কারিগর বিশ্বকর্মা ছদ্মবেশে এসে গোপনে মূর্তি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। একটি শর্ত ছিল যে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

যখন মূর্তিগুলি সম্পূর্ণ হয়, তখন দেখা যায় যে তাদের চোখ এখনও তৈরি করা হয়নি। ভগবান জগন্নাথের সহধর্মিণী দেবী লক্ষ্মী, একজন দিব্য শিল্পী রূপে আবির্ভূত হন এবং মূর্তিগুলিতে চোখ আঁকতে রাজি হন। তার শর্ত ছিল যে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে বিরক্ত করবে না। দুর্ভাগ্যবশত, অধৈর্য হয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী দেবী শেষ করার আগেই মন্দিরে প্রবেশ করেন। ফলে, দেবী লক্ষ্মী মূর্তির চোখ আঁকা সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

মূর্তি নির্মাণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত পবিত্র ও জটিল। নিমকাঠ বাছাই করার সময় বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন ঘনত্ব ও গঠন বিবেচনা করা হয়। দক্ষ কারিগররা, যাদের মূর্তিকার বলা হয়, অত্যন্ত যত্ন সহকারে কাঠ কেটে দিব্য রূপ তৈরি করেন, মুখের বৈশিষ্ট্য, অলঙ্কার ও পোশাকের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে।

জগন্নাথের মূর্তি তার অনন্য রূপের জন্য পরিচিত, যার বড় গোলাকার চোখ এবং সরলীকৃত মুখের অভিব্যক্তি রয়েছে। জগন্নাথের প্রধান মূর্তিতে হাত ও পায়ের অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য, যা দিব্য পূর্ণতা এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ঊর্ধ্বে উত্থানের ধারণাকে প্রতীকিত করে।

পশ্চিমবঙ্গ হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBHIDCO) দ্বারা নির্মিত এই মন্দিরের নকশা ও স্থাপত্য দেখভাল করছে কলকাতা-ভিত্তিক সেলিয়েন্ট ডিজাইন স্টুডিও। মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকবে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার পবিত্র মূর্তি, যা ভারত ও বিদেশ থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করবে।

এমন আশা করা হচ্ছে যে এই মন্দির দিঘার পর্যটন পরিমণ্ডলে নতুন মাত্রা যোগ করবে, যেমনটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, একবার মন্দির জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হলে বড় সংখ্যক ভক্ত মন্দির দর্শন করবেন এবং পর্যটকরা ওড়িশার পুরীর মতোই দিঘার সমুদ্র সৈকতের সুবিধাগুলি উপভোগ করতে পারবেন।

এই মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় কেন্দ্রই নয়, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবেও গড়ে উঠবে। শতাব্দী প্রাচীন জগন্নাথ উপাসনার ঐতিহ্য বাংলার মাটিতে নতুন করে রূপ নেবে, যা আমাদের সনাতন ঐতিহ্যের সমৃদ্ধিকে প্রমাণ করে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।