গরমের তীব্রতা আর আর্থিক সংকটের মাঝে ব্রিগেডে সমাবেশ করার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে সিপিএম। তবে হাল ছাড়তে নারাজ দলটির নেতৃত্ব এখন চারটি কৌশলের মাধ্যমে মাঠ ভরানোর চেষ্টায় নেমেছে। আসন্ন এপ্রিল মাসে ব্রিগেডে বড় জনসভার পরিকল্পনা থাকলেও, আর্থিক সংকটের কারণে ছাউনি বসানোর মতো খরচ বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দলের শাখা সংগঠনগুলোকে সামনে রেখে জনসমাগম বাড়ানোর নতুন পরিকল্পনা সাজিয়েছে সিপিএম। এই ঘটনা দলের বর্তমান সংগঠনিক ও আর্থিক দুর্বলতার পাশাপাশি আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির একটি ইঙ্গিতও দিচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরে সিপিএমের নেতৃত্ব ব্রিগেডে একটি বড় সমাবেশের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে আসছিল। এপ্রিল মাসে এই সমাবেশের মাধ্যমে দলের শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু গরমের তীব্রতা এবং ছাউনি বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রিগেডের মতো বিশাল মাঠে জনসভা করতে হলে শুধুমাত্র ছাউনি, মঞ্চ আর শব্দযন্ত্রের জন্যই লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। এই পরিস্থিতিতে দলের কাছে পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় নেতৃত্ব বিকল্প পথ খুঁজতে শুরু করে। তারা ঠিক করেছে, খরচ কমিয়ে শাখা সংগঠনগুলোর ওপর ভর করে জনসমাগম ঘটানো হবে। এই কৌশলের মধ্যে রয়েছে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা, সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, স্থানীয় ইস্যুতে আন্দোলন এবং দলীয় কর্মীদের সক্রিয় করা।
ঘটনার পেছনে আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, সিপিএম বর্তমানে বাংলায় এক কঠিন সময় পার করছে। ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটির প্রভাব ক্রমশ কমেছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে একটিও আসন জিততে না পারা এবং বিধানসভায় শূন্য প্রতিনিধিত্ব দলের দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিগেডে সমাবেশের মতো বড় আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নতুন করে উৎসাহ ফেরানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকট এই পরিকল্পনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়ায় তহবিল সংগ্রহে সমস্যা বেড়েছে। এর ফলে বড় আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা এখন দলের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই খরচ কমানোর পাশাপাশি সংগঠনের শক্তি দিয়ে মাঠ ভরানোর পরিকল্পনায় মন দিয়েছে নেতৃত্ব।
এই প্রেক্ষাপটে সিপিএম চারটি নির্দিষ্ট কৌশলের ওপর জোর দিচ্ছে। প্রথমত, দলের যুব ও ছাত্র সংগঠন যেমন এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই-কে সামনে রাখা হচ্ছে। এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তরুণদের সমাবেশে আনার চেষ্টা চলছে। দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি দলটি সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারের জন্য কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে। তৃতীয়ত, স্থানীয় সমস্যাগুলোকে ইস্যু করে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে। চতুর্থত, দলের নিচুতলার কর্মীদের সক্রিয় করে গ্রামে-গঞ্জে প্রচার জোরদার করা হচ্ছে। এই চার কৌশলের মাধ্যমে নেতৃত্ব আশা করছে, খরচ কমিয়েও ব্রিগেডে যথেষ্ট জনসমাগম ঘটানো সম্ভব হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য সিপিএমের অতীত ও বর্তমানের তুলনা করা যেতে পারে। একসময় বাংলায় ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা এই দল ব্রিগেডে লাখো মানুষের সমাগম ঘটাতো। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৩৫টি আসন জিতেছিল, যেখানে তৃণমূল পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। কিন্তু ২০১১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটির প্রভাব কমতে শুরু করে। ২০১৫ সালে দলের প্লেনামে দেখা গিয়েছিল, ৩১ বছরের নিচে সদস্য ছিল মাত্র ৪.৬ শতাংশ, যা এখন ৪.৩ শতাংশে নেমেছে। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, তরুণ প্রজন্মের সমর্থন কমে যাওয়ায় দলের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে। এছাড়া শ্রমিক শ্রেণি থেকে নতুন সদস্য কম আসছে, যা দলের আর্থিক শক্তিকেও প্রভাবিত করছে।
তবে সিপিএমের এই প্রচেষ্টা কতটা ফল দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। দলের অভ্যন্তরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্মেলনে জেলা সম্পাদক নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রাজ্য নেতৃত্বের পছন্দের প্রার্থী মৃণাল চক্রবর্তী ভোটে হেরে যান, এবং নতুন সম্পাদক পলাশ দাসের নিয়োগ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরনের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দলের ঐক্য ও সংগঠনিক শক্তির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার বাড়ালেও, তরুণদের মধ্যে দলের প্রতি আগ্রহ কম থাকায় এর ফলাফল নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সব মিলিয়ে, সিপিএমের এই নতুন কৌশল ব্রিগেডে মাঠ ভরাতে কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলবে। আর্থিক সংকটের মধ্যেও দলটি তার পুরোনো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তরুণ প্রজন্মকে না টানতে পারলে এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দলের ভাগ্য বদলানো কঠিন হবে। এই সমাবেশ তাই কেবল একটি জনসভা নয়, সিপিএমের বর্তমান শক্তি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার একটি পরীক্ষাও বটে।