global smoking pandemic: আমাদের আধুনিক পৃথিবীতে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও তামাক ব্যবহারের ভয়ানক চিত্র এখনও বিশ্বব্যাপী একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখনও ১২৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। এই বিশাল সংখ্যা আমাদের সামনে তুলে ধরে যে, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। যদিও গত দুই দশকে ধূমপানের হার কমেছে, তবুও প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করছে।
বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা
২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ তামাক ব্যবহার করে, যা ২০০০ সালে ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ। এই হ্রাসের হার যদিও উৎসাহব্যঞ্জক, কিন্তু এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ এই মরণঘাতী অভ্যাসের শিকার।
পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হারে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের হার ৩২.৬ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৬.৫ শতাংশ। এই লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়, তবে ইউরোপীয় অঞ্চলে এই ব্যবধান তুলনামূলকভাবে কম।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এবং উদ্বেগজনক প্রবণতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে তামাক ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি, যা ২৬.৫ শতাংশ1। এই অঞ্চলে ভারত একটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক চিত্র উপস্থাপন করে। ২০২২ সালে ভারতে প্রায় ২৫৩ মিলিয়ন তামাক ব্যবহারকারী রয়েছে, যার মধ্যে ২০০.২ মিলিয়ন পুরুষ এবং ৫৩.৫ মিলিয়ন নারী। এই সংখ্যা ভারতকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে রেখেছে।
ইউরোপীয় অঞ্চলও পিছিয়ে নেই, যেখানে তামাক ব্যবহারের হার ২৫.৩ শতাংশ1। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপীয় অঞ্চলে তামাক ব্যবহারের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইউরোপীয় অঞ্চলে নারীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার বিশ্ব গড়ের দ্বিগুণ এবং অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে কমছে।
স্বাস্থ্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব
তামাক ব্যবহারের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালানো হলেও এটি এখনও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে অকাল মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে ৭০ লাখেরও বেশি মৃত্যু সরাসরি তামাক ব্যবহারের কারণে এবং প্রায় ১৩ লাখ মৃত্যু পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ঘটে।
ভারতের মতো দেশে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ২০২১ সালে ভারতে ধূমপান সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০,৪৮,২৬৬ জন, যা দেশের মোট মৃত্যুর ৮.৯২ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি – ৮,১৪,৫৮৭ জন পুরুষ মারা গেছে, যা সকল পুরুষের মৃত্যুর ১২.২৩ শতাংশ।
তামাক নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি এবং চ্যালেঞ্জ
বিশ্বব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। ১৫০টি দেশ সফলভাবে তামাক ব্যবহারের হার কমাতে পেরেছে। ব্রাজিল এবং নেদারল্যান্ডস এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সফল হয়েছে। ব্রাজিল ২০১০ সাল থেকে ৩৫ শতাংশ আপেক্ষিক হ্রাস অর্জন করেছে।
১৯৯০ সাল থেকে পুরুষদের মধ্যে ধূমপানের হার ২৭.২ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ৩৭.৯ শতাংশ কমেছে। উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এই হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি, কোনো কোনো দেশে ৪০ শতাংশেরও বেশি কমেছে।
তবে এই অগ্রগতির পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কঙ্গো, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, জর্ডান, ওমান এবং মলদোভা প্রজাতন্ত্রে তামাক ব্যবহার এখনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৩-১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে তামাক ও নিকোটিন পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে অনেক দেশে।
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস এবং লক্ষ্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ তামাক ব্যবহার কমানোর লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ব পিছিয়ে রয়েছে। বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী মাত্র ২৫ শতাংশ আপেক্ষিক হ্রাস সম্ভব হবে। মাত্র ৫৬টি দেশ এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
আফ্রিকান অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল ৩০ শতাংশ হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনের পথে রয়েছে। আমেরিকার অঞ্চল ২৭ শতাংশ, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ২০ শতাংশ, ইউরোপীয় অঞ্চল ১৭ শতাংশ এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ১৩ শতাংশ হ্রাসের দিকে এগোচ্ছে।
তামাক শিল্পের বাধা এবং হস্তক্ষেপ
তামাক নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতির পথে তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ একটি বড় বাধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, তামাক শিল্প অগণিত জীবনের বিনিময়ে মুনাফা অর্জনের জন্য যে কোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে না। গ্লোবাল টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ইন্টারফেরেন্স ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য নীতিকে তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা আরও দুর্বল হয়েছে।
ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা
বিশ্বে এখনো ১২৫ কোটি মানুষের তামাক ব্যবহার একটি গুরুতর বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও গত দুই দশকে উন্নতি হয়েছে, তবুও আমাদের আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের তামাক ব্যবহার থেকে রক্ষা করা, তামাক শিল্পের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা এবং MPOWER নীতিমালা বাস্তবায়নে আরও জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন।
তামাকমুক্ত বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিটি দেশের সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। কেবলমাত্র এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও তামাকমুক্ত পৃথিবী নিশ্চিত করতে পারব।