ভারতের প্রতিটি কাগজের টাকার নোট শুধুমাত্র লেনদেনের মাধ্যম নয়, এর পিছনে রয়েছে দেশের গৌরবময় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছাপ। ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০ এবং ৫০০ টাকার নোটের পিছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও স্মারকের ছবি রয়েছে, যা ভারতের বৈচিত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরে। এই ছবিগুলো কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানবো, কোন নোটে কী ছবি আছে, কেন এগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনের তাৎপর্য কী।
প্রথমেই আসি ১০ টাকার নোটের কথায়। এই নোটের পিছনে রয়েছে ওড়িশার বিখ্যাত কোণার্ক সূর্য মন্দিরের ছবি। ১৩শ শতকে নির্মিত এই মন্দিরটি সূর্যদেবতার রথের আকারে তৈরি, যা ভারতের স্থাপত্যশিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় থাকা এই স্থানটি ভারতের প্রাচীন বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রতীক। এটি নোটে স্থান পেয়েছে কারণ এটি দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গভীরতাকে প্রকাশ করে। ২০১৮ সালে নতুন ডিজাইনের ১০ টাকার নোটে এই ছবি যুক্ত হয়, যা জনগণের মধ্যে ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়।
এবার ২০ টাকার নোটের দিকে নজর দেওয়া যাক। এখানে দেখা যায় মহারাষ্ট্রের এলোরা গুহার ছবি। এলোরা গুহা, যা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শতকের মধ্যে নির্মিত। এটি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি স্থাপত্য। এই ছবি বেছে নেওয়ার কারণ হলো ভারতের ধর্মীয় সহাবস্থান ও শিল্পের বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা। ২০১৯ সালে প্রকাশিত নতুন ২০ টাকার নোটে এই চিত্রটি যুক্ত হয়, যা দেশের প্রাচীন শিল্পকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
৫০ টাকার নোটের পিছনে রয়েছে কর্নাটকের হাম্পির পাথরের রথের ছবি। হাম্পি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এবং এর পাথরের রথটি ভারতের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃত এই স্থানটি ২০১৬ সালে নতুন ৫০ টাকার নোটে যুক্ত হয়। এটি বেছে নেওয়া হয়েছে কারণ এটি ভারতের ইতিহাসে বাণিজ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির প্রতীক। এই ছবি জনগণকে মনে করিয়ে দেয় যে, ভারতের অতীত কতটা গৌরবময় ছিল।
একটু বড় নোটের দিকে এগোলে, ১০০ টাকার নোটে দেখা যায় গুজরাটের রানি কি ভাব (রানির সিঁড়ি)। এটি ১১শ শতকে নির্মিত একটি সুন্দর সিঁড়ি-কূপ, যা রানি উদয়মতি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় থাকা এই স্থাপত্যটি ভারতের প্রাচীন জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রতীক। ২০১৮ সালে প্রকাশিত নতুন ১০০ টাকার নোটে এটি স্থান পায়। এই ছবি দেশের পরিবেশ সচেতনতা ও স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়কে তুলে ধরে।
২০০ টাকার নোটের পিছনে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের সাঁচি স্তূপের ছবি। এই স্তূপটি সম্রাট অশোকের সময়ে নির্মিত এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম স্মারকগুলোর একটি। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এই নোটে সাঁচি স্তূপ যুক্ত হয়েছে, যা ভারতের ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো বৌদ্ধ ধর্মের শান্তি ও জ্ঞানের বার্তাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটি ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যেরও প্রতীক।
শেষে আসি ৫০০ টাকার নোটে। এখানে রয়েছে দিল্লির লাল কেল্লার ছবি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৭শ শতকে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। ২০১৬ সালে নোট বাতিলের পর নতুন ৫০০ টাকার নোটে এটি যুক্ত হয়। লাল কেল্লা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক, কারণ এখান থেকেই প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এটি জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই নোটগুলোর ডিজাইন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক (আরবিআই) নির্ধারণ করে। প্রতিটি ছবি বাছাইয়ের পেছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে—দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের গুরুত্বকে তুলে ধরা। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালের নোট বাতিলের পর নতুন নোটে এই ধরনের ঐতিহাসিক স্থানের ছবি যুক্ত করা হয়েছে, যাতে জনগণের মধ্যে দেশের গৌরব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে। এছাড়া, নোটের রঙ ও আকারও ভিন্ন রাখা হয়েছে, যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এগুলো সহজে চিনতে পারেন।
সুতরাং, পরের বার যখন আপনি এই নোটগুলো হাতে নেবেন, একটু খেয়াল করে দেখবেন এর পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্প। এগুলো শুধু টাকা নয়, ভারতের অতীত ও বর্তমানের একটি জীবন্ত চিত্র।