Benefits of bichuti leaves: প্রকৃতির অপার রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন অনেক উপকারী উদ্ভিদ যা আমরা প্রথম দর্শনে এড়িয়ে চলি। বিছুটি পাতা তেমনই একটি বিস্ময়কর ভেষজ যার নাম শুনলেই চুলকানির কথা মনে আসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই একই পাতা যা স্পর্শে চুলকানি সৃষ্টি করে, সেটিই সঠিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত করলে হয়ে ওঠে অত্যন্ত পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার। বিছুটি পাতা অনেক গুণে সমৃদ্ধ এটিকে রান্না করবেন কী ভাবে – এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন জেনে নিই এর পুষ্টিগুণ ও সঠিক প্রস্তুতি পদ্ধতি।
বিছুটি পাতা কী এবং কেন এত বিশেষ?
বিছুটি পাতার বৈজ্ঞানিক নাম Tragia involucrata, যা ইউফোরবিয়াসেই পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। উত্তরবঙ্গে একে ছোতরা পাতা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে বেশোতক্তা এবং ময়মনসিংহে চোতরা নামে ডাকা হয়। এই গাছের পাতা ও কাণ্ডে অতি সূক্ষ্ম লোমের মতো ট্রাইকোম থাকে যা স্পর্শ করলে হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন ও সেরোটোনিন নিঃসরণ করে চুলকানি সৃষ্টি করে।
তবে এই পাতার পুষ্টিগুণ অসাধারণ। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি, সি ও কে, পাশাপাশি আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও প্রোটিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণাগুণ শরীরের সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
স্বাস্থ্য উপকারিতা যা জানলে অবাক হবেন
মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধ
বিছুটি পাতার অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল গুণ মূত্রনালীর সংক্রমণ বা ইউটিআই প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। এটি শরীর থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।
বাতের ব্যথা উপশম
গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত বিছুটি পাতার চা পান করলে বাতের ব্যথা অনেকটা কমে যায়। এর প্রাকৃতিক ব্যথানাশক গুণ হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধেও সহায়ক।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
বিছুটি পাতার রস নিয়মিত সেবনে শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
বিছুটি পাতা রান্নার পূর্ব প্রস্তুতি
বিছুটি পাতা অনেক গুণে সমৃদ্ধ এটিকে রান্না করবেন কী ভাবে জানার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সঠিক প্রস্তুতি। কাঁচা অবস্থায় এই পাতা স্পর্শ করা বিপজ্জনক, তাই রান্নার আগে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- পুরু গ্লাভস পরে পাতা সংগ্রহ করুন
- চিমটা বা তাং ব্যবহার করে পাতা ধরুন
- পাতা পরিষ্কার করার সময় সরাসরি হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন না
পাতা পরিষ্কার করার পদ্ধতি
প্রথমে পাতাগুলো ঠান্ডা পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিন। এরপর ১০-১৫ মিনিট ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করুন। এই প্রক্রিয়ায় পাতার চুলকানি সৃষ্টিকারী উপাদান নষ্ট হয়ে যায় এবং পাতা খাওয়ার উপযোগী হয়।
বিছুটি পাতার সুস্বাদু রান্নার রেসিপি
বিছুটি পাতার চা তৈরি
এটি সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। এক কাপ গরম পানিতে দুই চামচ শুকনো বিছুটি পাতার গুঁড়ো দিয়ে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। মধু মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করুন। এটি রক্তাল্পতার ঝুঁকি কমায় ও শ্বাসকষ্টে উপকার করে।
বিছুটি পাতার স্যুপ
সিদ্ধ করা বিছুটি পাতা কুচি করে কেটে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার সাথে ভেজে নিন। এরপর পানি দিয়ে ১৫-২০ মিনিট রান্না করুন। লবণ ও মরিচ দিয়ে স্বাদ নিন। এই স্যুপ সর্দি-কাশি ও জ্বরে বিশেষ উপকারী।
বিছুটি পাতার ভর্তা
সিদ্ধ করা পাতা পানি ঝরিয়ে ভালোভাবে মেশে নিন। কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, রসুন ও সরিষার তেল দিয়ে মেখে নিন। এই ভর্তা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী।
আধুনিক খাদ্য প্রযুক্তিতে বিছুটি পাতা
বর্তমানে গবেষকরা বিছুটি পাতা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি করার কাজ করছেন। উত্তরাখণ্ডের আলমোড়ায় চিকিৎসক বসুধা পন্থের নেতৃত্বে ‘নেটলস অফ হিমালয়া’ প্রকল্পের অধীনে বিছুটি পাতা থেকে চা, ময়দা, প্যানকেক মিক্স, চিলা মিক্স, কাটলেট মিক্স, লবণ, নিমকি, বড়ি সহ ১৫টি পণ্য তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।
কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ললিত তিওয়ারি জানিয়েছেন যে এই পাতা জ্বর কমাতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, পিঠের ব্যথা ও মচকানো নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার ও আয়ুর্বেদিক গুণাগুণ
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর ‘চিরজ্ঞীব বনৌষধি’ বইতে বিছুটি পাতার বিভিন্ন ভেষজ প্রয়োগের কথা উল্লেখ করেছেন। এর ফল ও শিকড় প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া, মাথাব্যথা, কুষ্ঠরোগ, চর্মরোগ, চুলপড়া, বুক ধড়ফড়ানি ইত্যাদি সমস্যায় ব্যবহৃত হয়।
প্রাচীনকালে রোমানরা উষ্ণতা প্রাপ্তির জন্য এই পাতা ব্যবহার করত। মিশরে বাত ও পিঠের ব্যথা উপশমে এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। আসাম অঞ্চলের কিছু বৈদ্য এটিকে উন্মাদ রোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহার করেন।
সেবনের সময় সতর্কতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও বিছুটি পাতা অনেক গুণে সমৃদ্ধ এটিকে রান্না করবেন কী ভাবে জানা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর সেবনে কিছু সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন। গর্ভবতী মহিলাদের এই পাতা সেবন এড়িয়ে চলা উচিত। যাদের রক্তচাপের সমস্যা আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করুন।
প্রথমবার সেবনের সময় অল্প পরিমাণে খেয়ে দেখুন কোনো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। অতিরিক্ত সেবনে পেটের অস্বস্তি বা ডায়রিয়া হতে পারে।
পুষ্টিগুণ ও দৈনিক প্রয়োজনীয়তা
বিছুটি পাতায় প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৪২ ক্যালোরি শক্তি রয়েছে। এতে প্রোটিন ২.৭ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৭.১ গ্রাম এবং ফ্যাট ০.১ গ্রাম থাকে। ভিটামিন সি-এর পরিমাণ কমলার চেয়েও বেশি। আয়রনের পরিমাণ পালংশাকের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
দৈনিক ১-২ কাপ বিছুটি পাতার চা বা রান্না করা পাতা খেলে শরীরের পুষ্টির চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হয়। তবে অবশ্যই সংযমের সাথে সেবন করতে হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও গবেষণা
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিছুটি পাতার বাণিজ্যিক চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ইউরোপ ও আমেরিকায় ইতিমধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে। আমাদের দেশেও এই ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা তৈরি হলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে।
গবেষকরা এই পাতা থেকে প্রাকৃতিক রং, প্রসাধনী ও ওষুধ তৈরির কাজও করছেন। ভবিষ্যতে এটি হতে পারে টেকসই কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিছুটি পাতা অনেক গুণে সমৃদ্ধ এটিকে রান্না করবেন কী ভাবে – এই প্রশ্নের উত্তর এখন আপনার জানা। প্রকৃতির এই অমূল্য উপহারকে সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবহার করে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারি। তবে মনে রাখবেন, যেকোনো ভেষজ ব্যবহারের আগে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সবসময়ই ভালো। প্রাকৃতিক এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর ও টেকসই জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।