বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যানসার ক্রমশ একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে উঠছে। এই রোগের প্রকোপ শুধু ধূমপায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যারা কখনো সিগারেটে টান দেননি, তাদের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ধূমপানের পাশাপাশি বায়ুদূষণ, জিনগত পরিবর্তন এবং পরোক্ষ ধূমপানের মতো কারণগুলো এই রোগের বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ক্যানসার একবার শরীরে বাসা বাঁধলে চিকিৎসার মাধ্যমেও এটিকে পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ছে, যা প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এই রোগের ভয়াবহতা বোঝার জন্য ঘটনার পেছনের পুরো চিত্রটি জানা জরুরি। বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এবং এর পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে ধূমপানকে এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধূমপান করেন না, তাদের মধ্যেও এই রোগের হার বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যানসার গবেষণা সংস্থা (আইএআরসি) জানিয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫ লাখ মানুষের ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়েছে, এবং এর মধ্যে একটি বড় অংশ অধূমপায়ী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বায়ুদূষণ এবং জিনগত পরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাতাসে ধুলো, কার্বন কণা এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ ফুসফুসে প্রবেশ করে কোষের ক্ষতি করছে। এছাড়া, পরিবারের কেউ ধূমপান করলে তার ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা, যাকে ‘প্যাসিভ স্মোকিং’ বলা হয়, তাও এই রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসায় সাফল্য মেলে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা উন্নত পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন, যখন ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই সমস্যার মূলে কেবল ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়, পরিবেশগত ও জৈবিক কারণও রয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার সেন্টার এবং পুনের ওয়ান সেল ডায়াগনোসিস সেন্টারের চিকিৎসকেরা দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেখেছেন, ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যাওয়া রোগীদের বেশিরভাগের শরীরে জিনগত পরিবর্তন ঘটেছিল। এই গবেষণার ফল ‘ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব মেডিক্যাল অনকোলজি ওপেন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, দুটি নির্দিষ্ট জিনের পরিবর্তন এই রোগের জন্য দায়ী হতে পারে। এই জিনগুলো পরিবেশের দূষণ বা অন্যান্য কারণে সক্রিয় হয়ে কোষে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়, যা পরে ক্যানসারে রূপ নেয়। বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও যানবাহনের ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ যেভাবে বেড়েছে, তা ফুসফুসের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামাঞ্চলেও কাঠের চুলার ধোঁয়া এবং ধুলোবালি এই রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই জিনগত পরিবর্তন প্রতিরোধে আরও গবেষণা হলে ভবিষ্যতে চিকিৎসায় নতুন পথ খুলতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ফুসফুসের ক্যানসারের ধরন এবং এর বিস্তার। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অধূমপায়ীদের মধ্যে যে ধরনের ক্যানসার বেশি দেখা যাচ্ছে, তা হলো ‘অ্যাডেনোকার্সিনোমা’। এটি ফুসফুসের ক্যানসারের চারটি প্রধান ধরনের মধ্যে অন্যতম এবং এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। আইএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, যারা কখনো ধূমপান করেননি, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই এই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই রোগ কম দেখা গেলেও, প্যাসিভ স্মোকিংয়ের কারণে নারীদের ঝুঁকিও বাড়ছে। এছাড়া, পরিবারে ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হয়ে যায়। গত ৪০ বছরে বিশ্বের অনেক দেশে পুরুষদের ফুসফুসের ক্যানসার কমলেও, নারীদের ক্ষেত্রে এটি বাড়ছে, যা বাংলাদেশেও লক্ষণীয়।
সহজ কথায় বলতে গেলে, এই রোগ থেকে বাঁচতে প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। ধূমপান ত্যাগ করা জরুরি, কিন্তু যারা ধূমপান করেন না, তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। বায়ুদূষণ কমাতে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রয়োজন। শহরে মাস্ক ব্যবহার, গাছ লাগানো এবং শিল্প কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। গ্রামে কাঠের চুলার বদলে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া দরকার। চিকিৎসকেরা বলছেন, কাশি, শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথার মতো লক্ষণ দেখলে দ্রুত পরীক্ষা করানো উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির মাধ্যমে রোগ নিরাময় সম্ভব। তবে বাংলাদেশে বেশিরভাগ রোগী শেষ পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, যখন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র ১৪ শতাংশ।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, ফুসফুসের ক্যানসারের এই ভয়াবহ রূপ ঠেকাতে সচেতনতা বাড়ানোই এখন সবচেয়ে জরুরি। ধূমপানের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ এবং জিনগত কারণ এই রোগের পেছনে কাজ করছে। বিজ্ঞানীরা এই জিনগত পরিবর্তনের প্রতিরোধে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে ভবিষ্যতে আরও কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব হয়। তবে এখনই পদক্ষেপ না নিলে এই রোগের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে, যা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সুস্থ ফুসফুসের জন্য সুস্থ পরিবেশ এবং সঠিক জীবনযাপনই হতে পারে আমাদের প্রথম প্রতিরক্ষা।