Rise of centenarians worldwide: বিশ্বব্যাপী দীর্ঘায়ু মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ শতবর্ষী জনসংখ্যা বিগত কয়েক দশকে অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্বব্যাপী শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৭৩,০০০ পর্যন্ত পৌঁছাবে, যা ১৯৯০ সালে ছিল মাত্র এক-চতুর্থাংশ। বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার উন্নতির কারণে এই সংখ্যা আগামী দশকগুলিতে আরও দ্রুত বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বৈশ্বিক শতবর্ষী জনসংখ্যার বর্তমান চিত্র
২০০০ সালে বিশ্বে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬২,০০০। কিন্তু বর্তমানে এই সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বে প্রায় ৭২২,০০০ শতবর্ষী মানুষ রয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় যে গত দুই দশকে শতবর্ষী জনসংখ্যা চার গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে জাপান হলো সর্বাধিক শতবর্ষী জনসংখ্যার দেশ, যেখানে প্রায় ১৪৬,০০০ শতবর্ষী বাস করে। এর পরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে এই সংখ্যা প্রায় ১০১,০০০। চীন (৬০,০০০), ভারত (৪৮,০০০) এবং থাইল্যান্ড (৩৮,০০০) যথাক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
শতবর্ষীদের জনসংখ্যার অনুপাত
জনসংখ্যার অনুপাতের দিক থেকে বিচার করলে জাপানে প্রতি ১০,০০০ জনে ১২ জন শতবর্ষী রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.০৬%। থাইল্যান্ডে এই হার প্রতি ১০,০০০ জনে ৫ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০,০০০ জনে ৩ জন। চীন ও ভারতে যেহেতু জনসংখ্যা বেশি কিন্তু গড় আয়ু তুলনামূলক কম, সেখানে প্রতি ১০,০০০ জনে ১ জনেরও কম শতবর্ষী রয়েছে।
শতবর্ষী জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণসমূহ
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি শতবর্ষী জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে হৃদরোগ চিকিৎসায় স্টেন্ট প্রতিস্থাপন পদ্ধতির উন্নতি, অ্যান্টিবায়োটিক যেমন পেনিসিলিন এর আবিষ্কার, এবং অন্যান্য মারাত্মক রোগের কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন মৃত্যুহার কমিয়েছে।
২০শ শতাব্দীর শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে গড় আয়ু প্রায় তিন দশক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পেছনে জনস্বাস্থ্য উন্নতির বিশেষ অবদান রয়েছে, যেমন খাবার পানি ক্লোরিনযুক্তকরণ যা পানিবাহিত রোগ কমিয়েছে।
জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন
শতবর্ষী হওয়ার পেছনে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে শতবর্ষী মানুষরা সাধারণত নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নেয়, সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখে এবং ধূমপান বা অতিরিক্ত মদ্যপান এড়িয়ে চলে।
যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগজনিত মৃত্যু হ্রাসের পেছনে ধূমপানের হার কমে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। গবেষণা থেকে জানা যায়, ধূমপান ছাড়লে মানুষের আয়ু কয়েক বছর বাড়তে পারে।
সামাজিক সম্পর্ক ও ইতিবাচক মানসিকতা
শতবর্ষীরা প্রায়শই শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন এবং জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে সামাজিক সমর্থন এবং মানসিক সুস্থতা সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। পরিবার ও বন্ধুদের সহায়ক নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকলে জীবনের উদ্দেশ্য ও পরিপূর্ণতার অনুভূতি আসে, যা দীর্ঘায়ু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
জিনগত কারণ
যদিও জিনগত কারণ একমাত্র বিষয় নয়, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে শতবর্ষী মানুষদের কিছু বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে যা তাদের দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। শতবর্ষী মানুষদের পরিবারে সাধারণত দীর্ঘায়ু ব্যক্তিদের সংখ্যা বেশি থাকে।
ভবিষ্যতে শতবর্ষী জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা
আগামী দশকগুলিতে অভূতপূর্ব বৃদ্ধি
জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫৪ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী শতবর্ষী জনসংখ্যা প্রায় ৪ মিলিয়নে পৌঁছাবে। আরো দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে, ২১০০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৭.৯ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে শতবর্ষী জনসংখ্যা আগামী তিন দশকে চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫৪ সালে প্রায় ৪২২,০০০ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.০৩% শতবর্ষী, কিন্তু ২০৫৪ সালে সেই অনুপাত ০.১% এ পৌছাতে পারে।
দেশ অনুযায়ী বৃদ্ধির হার
২০৫৪ সালের মধ্যে চীনে সর্বাধিক শতবর্ষী জনসংখ্যা থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা প্রায় ৭৬৭,০০০। এরপরে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও থাইল্যান্ড অবস্থান করবে। জনসংখ্যার অনুপাতের দিক থেকে, থাইল্যান্ডে প্রতি ১০,০০০ জনে ৪৯ জন, জাপানে ৪০ জন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ জন শতবর্ষী থাকবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
২০৫০ সালের মধ্যে জাপান এবং ইতালিতে শতবর্ষীদের অনুপাত সর্বাধিক হবে (প্রতি ১০,০০০ জনে যথাক্রমে ৪১.১ ও ৩৮.৩ জন)। চীনে এই সময়ের মধ্যে শতবর্ষীদের অনুপাত বর্তমানের তুলনায় ১৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি ১০,০০০ জনে ৪.৬ জনে পৌঁছাবে।
শতবর্ষী জনসংখ্যার বৃদ্ধির সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
জনসংখ্যার কাঠামোয় পরিবর্তন
শতবর্ষী জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে বিশ্বের জনসংখ্যার কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে। ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যার মধ্যেও শতবর্ষীদের অনুপাত বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ৩০ বছরে ৬৫+ বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে শতবর্ষীদের অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে ২০২৪ সালের ০.২% থেকে ২০৫৪ সালে ০.৫% এ উন্নীত হবে।
“বেবি বুম” প্রজন্মের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণকারী) বয়স বাড়ার সাথে সাথে শতবর্ষীদের সংখ্যা এই মুহূর্তে দ্রুত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এই প্রজন্মের পর শতবর্ষী জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর প্রভাব
শতবর্ষী জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। বয়স্ক মানুষের যত্ন, দীর্ঘমেয়াদী রোগের ব্যবস্থাপনা এবং অধিক বয়স্কদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। তবে আশার বিষয় হলো, যেহেতু আধুনিক শতবর্ষীরা আগের তুলনায় অধিক সুস্থ থাকছেন, তাই তাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা কানে তানাকা জাপানের ফুকুওকা প্রিফেকচারে বাস করেন এবং তার বয়স ১১৭ বছর। তিনি একজন “সুপার-শতবর্ষী”, যা ১১০ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্য একটি বিশেষ শ্রেণিবিন্যাস।
বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ স্পেনের সাতুর্নিনো দে লা ফুয়েন্তে, যার বয়স ১১২ বছর। এটি উল্লেখযোগ্য যে স্পেন, ফ্রান্স এবং ইতালির মতো দেশগুলিতে শতবর্ষীদের অনুপাত ইউরোপে সর্বাধিক (জনসংখ্যার প্রায় ০.০৩%)।
শতবর্ষী হওয়ার রহস্য: কী শিখতে পারি আমরা?
জীবনধারা সম্পর্কিত পরামর্শ
শতবর্ষীদের জীবনধারা থেকে আমরা অনেক মূল্যবান শিক্ষা পেতে পারি। প্রায় সব শতবর্ষী নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ, সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান থেকে বিরত থাকার মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুসরণ করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করাও দীর্ঘায়ু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং সামাজিক কার্যকলাপে সক্রিয় থাকা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ভবিষ্যতের গবেষণার দিক
শতবর্ষীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বিষয়ে আরো গবেষণার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দীর্ঘায়ু সম্পর্কিত জিনগত কারণ, পরিবেশগত প্রভাব এবং জীবনযাপন পদ্ধতির প্রভাব সম্পর্কে আরো গভীর অধ্যয়নের প্রয়োজন। এই গবেষণার ফলাফল সবার জন্য স্বাস্থ্যকর ও দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
পৃথিবীতে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানব জীবনের দীর্ঘায়ুর ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ২০০০ সালে যেখানে মাত্র ১৬২,০০০ শতবর্ষী ছিল, সেখানে ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ৭২২,০০০ এ পৌঁছেছে এবং ২১০০ সালের মধ্যে ১৭.৯ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিক সম্পর্ক এবং জিনগত কারণগুলি এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। দেশ হিসেবে বর্তমানে জাপান শতবর্ষীদের সংখ্যায় শীর্ষে থাকলেও, ২০৫৪ সাল নাগাদ চীন এই তালিকার শীর্ষে উঠবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের স্বাস্থ্য, সমাজ এবং অর্থনীতির উপর নানাবিধ প্রভাব ফেলবে। তবে এটি মানব জীবনের সম্ভাবনার নতুন দিগন্তও উন্মোচন করবে। শতবর্ষীদের জীবন থেকে শেখা পাঠগুলি আমাদের নিজেদের জীবনেও প্রয়োগ করে আমরা সুস্থ, সুখী এবং দীর্ঘ জীবনযাপন করতে পারি।
পৃথিবীতে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা কীভাবে বাড়ছে তা জানা শুধু একটি পরিসংখ্যানগত বিষয় নয়, এটি আমাদের মানব জীবনের সম্ভাবনা এবং গুণমানের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচকও বটে।