TRF behind Kashmir violence: কাশ্মীরের পাহলগাম এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ভয়াবহ হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু ঘটেছে। এই আক্রমণের দায় স্বীকার করেছে “দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট” (টিআরএফ) নামে পরিচিত একটি সংগঠন। অপেক্ষাকৃত অল্প পরিচিত এই জঙ্গি গোষ্ঠী ২০১৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী অনুসারে, এটি পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার (এলইটি) একটি শাখা সংগঠন হিসেবে কাজ করে।
টিআরএফ-এর উৎপত্তি ও পটভূমি
২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সূচক ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার পর টিআরএফ সংগঠনটি গড়ে উঠে। এই সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসন রহিত হয় এবং এলাকাটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আসে। এর পাশাপাশি, নতুন আইন অনুযায়ী বহিরাগতদের জম্মু-কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সরকারি চাকরিতে কোটা পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়, যা টিআরএফ-এর সদস্যরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
টিআরএফ নিজেকে একটি স্বদেশী কাশ্মীরি প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ভারতের কাছ থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে1। অন্যদিকে, ভারত সরকার অভিযোগ করেছে যে টিআরএফ আসলে লস্কর-ই-তৈবার একটি প্রচ্ছন্ন সংগঠন।
সংগঠনের নেতৃত্ব ও কাঠামো
টিআরএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মুহাম্মদ আব্বাস শেখ ও শেখ সাজ্জাদ গুলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাজ্জাদ গুল বর্তমানে সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ও সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। সংগঠনের অভিযানের দায়িত্বে ছিলেন বাসিত আহমেদ দার, যিনি ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন। সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে আহমেদ খালিদ কাজ করছেন।
এছাড়াও, সাম্প্রতিক পাহলগাম হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে লস্কর-ই-তৈবার সাইফুল্লাহ কাসুরিকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং হামলাকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন আসিফ ফৌজি।
টিআরএফ-এর বৈশিষ্ট্য ও কার্যপদ্ধতি
অন্যান্য কাশ্মীরি বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে টিআরএফ-এর একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল এর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রচারের প্রচেষ্টা। সংগঠনটি ইসলামিক নামকরণ ও প্রতীকী চিহ্ন ব্যবহার না করে নিজেকে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে উপস্থাপন করে। এর প্রতীক, বিবৃতি এবং আক্রমণের যৌক্তিকতা সবই হিজবুল মুজাহিদিনের মতো পূর্ববর্তী ইসলামপন্থী কাশ্মীরি বিদ্রোহীদের থেকে ভিন্ন।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার
টিআরএফ “ভার্চুয়াল ফ্রন্ট” হিসেবেও পরিচিত, কারণ এর গঠন ও কার্যক্রম মূলত সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। সংগঠনটি টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকে, যা তারা কাশ্মীরি যুবকদের নিয়োগ, সদস্য সংগ্রহ এবং তাদের কার্যক্রম প্রচারের জন্য ব্যবহার করে।
লক্ষ্য ও টার্গেট
২০২৩ সালে ভারত সরকার টিআরএফকে “সন্ত্রাসবাদী সংগঠন” হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। টিআরএফ বেসামরিক ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের, যেমন কাশ্মীরি হিন্দু, সরকারি কর্মচারী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং পর্যটকদের আক্রমণ করে। এছাড়াও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশের উপরও তারা হামলা চালিয়েছে।
পাহলগাম হামলা: টিআরএফ-এর সাম্প্রতিক কার্যকলাপ
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল, জম্মু ও কাশ্মীরের পাহলগাম অঞ্চলের বাইসারান উপত্যকায় পর্যটকদের উপর চালানো হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫ জন ভারতীয় এবং ১ জন নেপালি নাগরিক রয়েছে। এই হামলাটি গত বেশ কয়েক বছরে কাশ্মীরে বেসামরিক ব্যক্তিদের উপর সবচেয়ে মারাত্মক হামলা হিসেবে বিবেচিত।
হামলার পরে টিআরএফ টেলিগ্রাম চ্যানেলের মাধ্যমে দায়িত্ব স্বীকার করে এবং “বহিরাগতদের” বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর হুমকি দেয়। তারা জনবিন্যাসগত পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টাকে এই আক্রমণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর প্রভাব
পাহলগাম হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও অবনতি ঘটেছে। ভারত সরকার পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে এনেছে এবং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
টিআরএফ ও লস্কর-ই-তৈবার সম্পর্ক
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মতে, টিআরএফ আসলে লস্কর-ই-তৈবার (এলইটি) একটি শাখা সংগঠন। এলইটি পাকিস্তান-ভিত্তিক একটি জঙ্গি সংগঠন, যা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলাসহ ভারতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার সাথে জড়িত।
দিল্লি-ভিত্তিক সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পরিচালক অজয় সাহনি মতে, “এটি মূলত এলইটির একটি ফ্রন্ট। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স থেকে পাকিস্তানের উপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ার পর এই ধরনের গোষ্ঠীগুলি গড়ে উঠেছে, জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে তাদের সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করার নীতির অংশ হিসেবে”।
ফ্যালকন স্কোয়াড: বিশেষ হামলা বাহিনী
টিআরএফ-এর একটি বিশেষ আঘাতকারী বাহিনী রয়েছে যাকে “ফ্যালকন স্কোয়াড” নামে ডাকা হয়। এই দলটি টার্গেট কিলিং এবং অনুপ্রবেশ কৌশলে উচ্চ প্রশিক্ষিত। গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে, এই বাহিনী কাশ্মীরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালাতে ব্যবহৃত হয়।
টিআরএফ-এর অন্যান্য কার্যকলাপ
টিআরএফ পাহলগাম হামলা ছাড়াও কাশ্মীরে বেশ কিছু সহিংস ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, গান্দেরবালে একটি সুড়ঙ্গ নির্মাণ স্থলে হামলায় একজন ডাক্তার ও ছয় অস্থানীয় শ্রমিক নিহত হন, যার দায় টিআরএফ নিয়েছিল।
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের মতে, ২০২২ সালে উপত্যকায় নিহত সর্বাধিক সংখ্যক জঙ্গি টিআরএফ-এর সদস্য ছিল, যা প্রমাণ করে যে টিআরএফ এলইটির সবচেয়ে সক্রিয় প্রতিনিধি।
অর্থায়ন ও সমর্থন
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, টিআরএফকে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) দ্বারা সমর্থন করা হয়। সংগঠনটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যুবকদের নিয়োগ করে, যাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশে সাহায্য করা এবং পাকিস্তান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে অস্ত্র ও মাদক পাচারে সহায়তা করা অন্তর্ভুক্ত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
পাহলগাম হামলার পর বিশ্বের বিভিন্ন নেতা এই সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছেন, যার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইইউ প্রধান উরসুলা ফন ডের লেয়েন অন্যতম। কাতার সরকারও হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি হামলার কারণে সৌদি আরব সফর সংক্ষিপ্ত করেন, বলেছেন যে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তিনি এক্স প্ল্যাটফর্মে (পূর্বে টুইটার) একটি বিবৃতিতে লিখেছেন, “সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের সংকল্প অটল, এটি আরও শক্তিশালী হবে”।
টিআরএফ-এর সামনে চ্যালেঞ্জ
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী টিআরএফ-এর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। পাহলগাম হামলার পর, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ শ্রীনগরে একটি জরুরি নিরাপত্তা সভা আহ্বান করেন। ভারতীয় সেনা ও জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ হামলার স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে এবং হামলাকারীদের খোঁজে অভিযান চালাচ্ছে।
উপত্যকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে এবং পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিমান সংস্থাগুলি পর্যটকদের কাশ্মীর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু করেছে।
কাশ্মীর উপত্যকার বর্তমান পরিস্থিতি
এপ্রিল ২০২৫-এ সংঘটিত পাহলগাম হামলা, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কমে যাওয়ার ইতিবাচক ধারণাকে ধাক্কা দিয়েছে। হামলার আগে, মোদি সরকার কাশ্মীরে পর্যটন উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং ২০২৪ সালে প্রায় ৩১ লক্ষ পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছিলেন।
হামলার পর, শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভারত সরকারের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটি ভারতীয় ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র সেই বক্তব্যকেও ধাক্কা দিয়েছে যে তারা ৩৭০ ধারা রদ করে কাশ্মীরে শান্তি ও উন্নয়ন এনেছে।
The Resistance Front (টিআরএফ) একটি আপেক্ষিকভাবে নতুন, কিন্তু ক্রমবর্ধমানভাবে বিপজ্জনক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, যা কাশ্মীরে অশান্তি সৃষ্টি করতে সক্রিয় রয়েছে। এটি এমন একটি সংগঠন যা নিজেকে স্বদেশী কাশ্মীরি প্রতিরোধ হিসেবে উপস্থাপন করলেও, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটিকে পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্কর-ই-তৈবার সাথে জড়িত বলে মনে করে। সাম্প্রতিক পাহলগাম হামলায় ২৬ জন পর্যটকের মৃত্যু কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে এবং ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। আগামী দিনগুলিতে টিআরএফ-এর কার্যকলাপ ও ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে কাজ করবে।