বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের দ্বন্দ্ব একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের মধ্য দিয়ে যে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল, তার প্রতিধ্বনি আবারো দেশের রাজনৈতিক মাটিতে অনুভূত হচ্ছে। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে এই দুই ঘটনার প্রসঙ্গ উঠে আসছে এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তর্ক-বিতর্ক তীব্র হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, বরং বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বিভক্তি ও মতাদর্শগত সংঘর্ষের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে তরুণ প্রজন্ম শাহবাগ চত্বরে জড়ো হয়। তারা দাবি করেছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। এই আন্দোলন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর বিপরীতে, একই বছরের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ইসলামী সংগঠন শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ ডাকে। তাদের ১৩ দফা দাবির মধ্যে ছিল শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কিছু ব্লগার ও স্বঘোষিত নাস্তিকদের শাস্তি, ইসলামবিরোধী নীতি বাতিল এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার। ৫ মে রাতে এই সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়, যাতে অনেকে হতাহত হন। এই দুই ঘটনা বাংলাদেশের সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে এই দ্বন্দ্ব আবারো সামনে এসেছে। ২০২৫ সালের মার্চে সামাজিক মাধ্যমে “জাস্টিস ফর শাপলা ম্যাসাকার” এবং “শাহবাগ নো মোর” জাতীয় স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে মনে করছেন, শাপলা চত্বরে যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের ন্যায়বিচার এখনো পূরণ হয়নি। অন্যদিকে, শাহবাগ আন্দোলনের সমর্থকরা বলছেন, তাদের লড়াই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য। এই দুই পক্ষের মধ্যে তর্ক ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক মেরুকরণের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি এই দ্বন্দ্বকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
এই দ্বন্দ্বের গভীরতা বোঝার জন্য অতীতের কিছু তথ্য জানা জরুরি। শাহবাগ আন্দোলনের ফলে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পথ সুগম হয়। কিন্তু এটি হেফাজতের মতো সংগঠনের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা শাহবাগকে “নাস্তিকদের আন্দোলন” হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক প্রচার চালায়। শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেয়, যাতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সূত্রে মৃতের সংখ্যা ২৮ থেকে শতাধিক বলে দাবি করা হয়, যদিও সরকারি হিসেবে এটি অনেক কম। এই ঘটনা নিয়ে তদন্তের দাবি উঠলেও কোনো স্বাধীন কমিশন গঠন হয়নি। ফলে, এটি একটি অমীমাংসিত বিতর্ক হয়ে রয়ে গেছে।
বর্তমানে এই দ্বন্দ্বের প্রভাব স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভক্তি বাড়ছে, এবং রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। সমাজে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থকরা শাহবাগের পক্ষে কথা বলছেন, অন্যদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিনিধিরা শাপলা চত্বরের ঘটনাকে সামনে আনছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ কেউ মনে করেন, অতীতের এই সংঘর্ষ থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আবার অনেকে এটিকে বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখছেন।
সবশেষে বলা যায়, শাহবাগ-শাপলা দ্বন্দ্ব শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির গভীরে প্রোথিত একটি বিভাজন রেখা। এই দ্বন্দ্বের ছায়া যতদিন থাকবে, ততদিন দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে, সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপ ও সমঝোতার পথই হতে পারে এই বিভক্তি দূর করার একমাত্র উপায়।