১৫০০ কোটি টাকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা: মহাকাশের রহস্য ফুটবে এইচডি ছবিতে!

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরির কাজ চলছে, যার খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। এই অত্যাধুনিক ক্যামেরাটি মহাকাশের গভীর রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করবে। চিলির অরা অবজারভেটরিতে স্থাপিত…

Srijita Chattopadhay

 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ক্যামেরা তৈরির কাজ চলছে, যার খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা। এই অত্যাধুনিক ক্যামেরাটি মহাকাশের গভীর রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করবে। চিলির অরা অবজারভেটরিতে স্থাপিত হতে যাওয়া এই ক্যামেরার রেজল্যুশন হবে ৩২০০ মেগাপিক্সেল বা ৩.২ গিগাপিক্সেল। এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের এইচডি ছবি ও ভিডিও ধরা সম্ভব হবে, যা বিজ্ঞানীদের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। এই প্রকল্পে কাজ করছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ল্যাক গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা।

এই বিশাল প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে লার্জ সিনোপটিক সার্ভে টেলিস্কোপ (এলএসএসটি)। ক্যামেরাটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে প্রায় ২০ বছর আগে, এবং এটি সম্পূর্ণ হলে ২০২৫ সালের শুরুতে ছবি তোলার কাজ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ক্যামেরার ওজন প্রায় ২৮০০ কিলোগ্রাম, যা একটি ছোট গাড়ির সমান। এর আয়নার আকার ৮.৪ মিটার, এবং সামনে থাকবে ৫ ফুট চওড়া একটি লেন্স। এটি প্রতি ২০ সেকেন্ডে ১৫ সেকেন্ড এক্সপোজারের ছবি তুলতে পারবে। এক রাতে এটি প্রায় ২০ টেরাবাইট তথ্য সংগ্রহ করবে, যা ১০ বছরে মোট ৩৭ বিলিয়ন গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের তথ্য ধরে রাখতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মহাকাশের সবচেয়ে বিস্তারিত মানচিত্র তৈরি করবে।

এই ক্যামেরার অন্যতম লক্ষ্য হলো ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করা। মহাবিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ ভর এই ডার্ক ম্যাটার দ্বারা গঠিত, যা আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। এলএসএসটি ক্যামেরা এই গুপ্ত বস্তুর গতিশীলতা ও প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে। এছাড়া, এটি আমাদের সৌরজগতের ৬০ লাখ নতুন বস্তু এবং মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ১৭ বিলিয়ন নক্ষত্রের ত্রিমাত্রিক ছবি তুলতে সক্ষম হবে। প্রকল্পের নির্মাণ পরিচালক জেলকো ইভেজিচ বলেন, “এটি হবে সর্বকালের সবচেয়ে তথ্যপূর্ণ চলচ্চিত্র, যা মহাকাশের গতিশীলতা বোঝাতে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে।”

ক্যামেরাটির প্রযুক্তিগত দিক নিয়েও আলোচনা চলছে। এতে ১৮৯টি সিসিডি (চার্জড কাপল ডিভাইস) সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে, যা একসঙ্গে কাজ করে অসাধারণ রেজল্যুশন দেবে। এর দৈর্ঘ্য ১৩ ফুট এবং উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। এই ক্যামেরা এতটাই শক্তিশালী যে, চাঁদের পৃষ্ঠের সূক্ষ্ম কণা পর্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যাবে। বিজ্ঞানীদের দাবি, এটি ২৪ কিলোমিটার দূরের বস্তুর ছবিও তুলতে পারবে। এর ফলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ বা গ্রহাণুর গতিপথের মতো ঘটনা রেকর্ড করা সম্ভব হবে, যা আগে কখনো এত বিস্তারিতভাবে দেখা যায়নি।

এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশন ও এনার্জি ডিপার্টমেন্ট। চিলির আন্ডেস পর্বতমালায় অবস্থিত ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরিতে এটি স্থাপন করা হবে। এর নির্মাণে ক্যালিফোর্নিয়ার এসএলএসি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০২৭ সালের দিকে এর ছবি সাধারণ মানুষের জন্য প্রকাশ করা হবে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এটিকে ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ রেজল্যুশনের ক্যামেরা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

মহাকাশ গবেষণায় এই ক্যামেরা একটি মাইলফলক হতে চলেছে। এটি শুধু বিজ্ঞানীদের জন্যই নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও মহাবিশ্বকে কাছে আনবে। আগে যেখানে আমরা সাদা-কালো ছবি বা ঝাপসা ভিডিও দেখতাম, সেখানে এখন রঙিন এবং স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাবে। এটি আমাদের ছায়াপথের সৃষ্টি ও গঠন সম্পর্কে নতুন ধারণা দেবে। বিজ্ঞানীদের আশা, এর মাধ্যমে মহাকাশের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

এই ক্যামেরার ছবি কেমন হবে, তা নিয়ে সবার মনে কৌতূহল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি এমন স্পষ্টতা দেবে যে, আপনি মনে করবেন মহাকাশ যেন হাতের মুঠোয়। একটি নক্ষত্রের জন্ম থেকে শুরু করে তার বিস্ফোরণ—সবকিছুই এইচডি মানের ভিডিওতে দেখা যাবে। এটি শুধু বিজ্ঞানের জন্য নয়, মানুষের কল্পনাশক্তিকেও নতুন মাত্রা দেবে। ১৫০০ কোটি টাকার এই বিনিয়োগ মহাকাশের গল্পকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে এক অভূতপূর্ব উপায়ে।

About Author
Srijita Chattopadhay

সৃজিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক এবং সাংবাদিক, যিনি তার লেখা দ্বারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি তুলে ধরতে সদা উদ্যমী। সৃজিতার লেখার ধারা মূলত সাহিত্য, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন দিককে ঘিরে আবর্তিত হয়, যেখানে তিনি তার গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর নিবন্ধ ও প্রতিবেদনগুলি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা তার বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে। সৃজিতা তার কর্মজীবনে ক্রমাগত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর, যা তাকে বাংলা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।