High cholesterol warning signs: আজকের ব্যস্ত জীবনে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারার কারণে কোলেস্টেরল বৃদ্ধি একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর কোলেস্টেরলজনিত কারণে প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়, যা মোট মৃত্যুর ৭.৮% হিসেবে চিহ্নিত। অনেকেই জানেন না যে, তাদের শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে গেছে, কারণ এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। আজ আমরা জানব কীভাবে শরীরের বিভিন্ন লক্ষণ থেকে বুঝতে পারবেন যে আপনার কোলেস্টেরল বেড়েছে, এবং এই সমস্যা থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে পারেন।
কোলেস্টেরল হল রক্তে পাওয়া একটি মোমজাতীয় পদার্থ যা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয়। যকৃত এই কোলেস্টেরল তৈরি করে অথবা বাইরের খাবার থেকে গ্রহণ করে। শরীরের কোষের মেমব্রেন তৈরিতে, হরমোন এবং ভিটামিন তৈরিতে কোলেস্টেরল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোলেস্টেরল মূলত দুই ধরনের হয়:
এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরল: এটিকে “খারাপ কোলেস্টেরল” বলা হয়। এর মাত্রা বেশি হলে রক্তনালীতে জমা হয়ে প্ল্যাক তৈরি করে, যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
এইচডিএল (HDL) কোলেস্টেরল: এটিকে “ভালো কোলেস্টেরল” বলা হয়। এটি শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল বের করে দিতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে প্রায় ৮০.৪% প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ডিসলিপিডেমিয়া (রক্তে কোলেস্টেরলের অস্বাভাবিক মাত্রা) থেকে ভুগছেন, যার মধ্যে ২১.৭% উচ্চ টোটাল কোলেস্টেরল, ৩৫.৫% উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড, ২০.২% উচ্চ এলডিএল-সি এবং ৬৮.৯% নিম্ন এইচডিএল-সি এর সমস্যা রয়েছে।
কোলেস্টেরল বাড়লে শরীরে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। নিচে এমন কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হল যা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার কোলেস্টেরল বেড়েছে কি না:
বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করলে তা কোলেস্টেরলের একটি প্রধান এবং গুরুতর লক্ষণ হতে পারে। আসলে হৃদপিণ্ডের ধমনীতে কোলেস্টেরল জমা হওয়ার ফলে বুকে চাপ পড়ে। যার ফলে জ্বালাপোড়া বা টানটান অনুভূত হয়। এই ধরনের লক্ষণগুলি হার্ট অ্যাটাক বা করোনারি ধমনী রোগ (CAD) এর ইঙ্গিত হতে পারে।
কোলেস্টেরল বাড়লে ঘাড়ের চারপাশে ব্যথা হতে পারে। আসলে, কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পেলে পুরো শরীরের রক্তপ্রবাহ বাধা পেতে শুরু করে। যার জন্য ঘাড়ের চারপাশে, চোয়াল এবং কাঁধে অস্বাভাবিক ব্যথা, পেশীতে টান অনুভূত হতে পারে। ঘাড় ও মাথার পেছনে ভীষণ ব্যথাও হতে পারে।
কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিনঝিন বা ঠান্ডা লাগা অনুভব করা যেতে পারে। বিশেষ করে রাত্রের বেলায় এই লক্ষণগুলি বেশি দেখা যায়2। যদি বয়স ৩০ বছর হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে গরমেও হাত এবং আঙুল ঠান্ডা হয়ে থাকে, তা শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়ার ইঙ্গিত দিতে পারে।
অনেক সময়ে কোলেস্টেরল বৃদ্ধির কারণে পায়ের রঙও নীল দেখায়। অল্প হাঁটলেই পা যন্ত্রণা করতে পারে, মাঝেমধ্যেই পা অবশ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া যদি বয়স ৩০ বছর হয়ে থাকে হাতে বা পায়ে হঠাৎ হঠাৎ করে খিঁচ লেগে যায়, তাও খারাপ কোলেস্টেরলের লক্ষণ হতে পারে।
রাত্রিবেলায় কোলেস্টেরল বাড়ার বেশ কিছু বিশেষ লক্ষণ দেখা যায়। এগুলি হল:
শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল বাড়তে শুরু করলেই রাত্রিবেলায় আঙুল ব্যথা করতে পারে। এটি low-density lipoprotein (LDL) বাড়ার একটি লক্ষণ। শরীরে রক্ত সংবহনের মাত্রা খারাপ হলে হাত-পা ঝনঝন করে এবং আঙুল অবশ হয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে রাতের দিকে এবং বিশ্রামরত অবস্থায়।
উচ্চ কোলেস্টেরল রক্ত চলাচলের সমস্যা সৃষ্টি করে। এর ফলে রাতে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকে রাতে ঘুমাতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন, যা এক্ষেত্রে একটি সতর্কতা স্বরূপ।
কোলেস্টেরল বাড়লে চোখেও বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এগুলো হল:
কোলেস্টেরল বাড়লে চোখের চারপাশে হলুদ বর্ণ বা হলুদ বলয় দেখা দেয়। কোলেস্টেরল বেশি মাত্রায় থাকলে চোখের নিচে হলুদ ভাব দেখা যায়। এটি জন্ডিসের লক্ষণ নয়, বরং উচ্চ কোলেস্টেরলের কারণে হয়ে থাকে।
চোখের কর্নিয়ার পাশে ধূসর দাগ দেখা দিলে তা কোলেস্টেরলের লক্ষণ। এই ধরনের দাগ দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মাথায় ভারী ভাব বা মাথা ঘোরাও কোলেস্টেরলের লক্ষণ। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে অনেক সময় রক্তনালী আটকে যায়, যার ফলে মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলে বাধা পড়ে।
হাই কোলেস্টেরল শরীরে বাড়তে শুরু করলে ত্বকের রং বদলে যেতে পারে। চামড়ায় লালচে ভাব ছেয়ে যায়, যাকে জেথমা (Xanthomas) বলা হয়।
কোলেস্টেরল বাড়লে তার প্রভাব পড়ে নখেও। নখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে যায়, নখ হলুদ হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রেই নখের নীচের দিকে কালো ও বাদামি রঙের রেখাও চোখে পড়ে।
জিভ দেখেও বোঝা যায় শরীরে কোলেস্টেরল বাসা বাধছে কি না। জিভের ওপর বিবর্ণ ছোট ছোট দানা বের হয়। ছোট ছোট দানার মতো আস্তরণ যখন সারা জিভে ছড়িয়ে পড়ে ও রং পরিবর্তন করে, তখন সেই লক্ষণ উপেক্ষা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে দেখা যায় এমন ১০টি সতর্কতামূলক লক্ষণ
বাংলাদেশের নয়টি অঞ্চলের মধ্যে সিলেটে সবচেয়ে বেশি ডিসলিপিডেমিয়া (৮৫.৭%) এবং রংপুর অঞ্চলে সবচেয়ে কম (৭৪.৪%) দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নলিখিত গ্রুপের লোকেদের কোলেস্টেরল বাড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে:
সুগার (ডায়াবেটিস) রোগীরা
নিয়মিত মদ্যপান করেন যারা
ফাস্টফুড নিয়মিত খান যারা
ধূমপান করেন যারা
তলপেটে অতিরিক্ত মেদ জমা আছে এমন ব্যক্তিরা
পারিবারিক ইতিহাসে কোলেস্টেরলের সমস্যা আছে এমন ব্যক্তিরা
কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাদের গড় টোটাল কোলেস্টেরল ১৯০±৩৩ mg/dl, ট্রাইগ্লিসারাইড ১৩২±৪২ mg/dl, এইচডিএল কোলেস্টেরল ৫৩±১০ mg/dl, এলডিএল কোলেস্টেরল ১১৬±৩০ mg/dl ছিল।
ডা. রুদ্রজিৎ পালের মতে, কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই তেমন কোনও লক্ষণই দেখা যায় না। তাই সচেতন হয়ে নিয়মিত পরীক্ষা করানো জরুরি। কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে টেস্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা করতে হয়, যা রক্তে LDL, HDL, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নির্ণয় করে।
বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেন:
পুরুষদের ৪০ বছর বয়স পেরনোর পর
মহিলাদের ৪৫ বছর বয়স পেরনোর পর
অবশ্যই নিয়মিত কোলেস্টেরল পরীক্ষা করাতে হবে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিম্নলিখিত উপায়গুলি অবলম্বন করতে পারেন:
স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাট কমিয়ে পলিআনস্যাচুরেটেড ও মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ করুন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন দৈনিক ক্যালোরির ৬% এর কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণের পরামর্শ দেয় এবং ট্রান্স ফ্যাট একেবারে এড়িয়ে চলতে বলে।
নিম্নলিখিত খাবারগুলি কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে:
ওটমিল
আপেল, আঙ্গুর, স্ট্রবেরি, লেবু জাতীয় ফল
সয়াবিন এবং টোফু
ফ্যাটি ফিশ যেমন সালমন, টুনা ইত্যাদি
বাদাম যেমন আলমন্ড, পিনাট ইত্যাদি
অ্যাভোকাডো
ভেজিটেবল অয়েল যেমন অলিভ অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল ইত্যাদি
নিয়মিত ব্যায়াম করুন। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা মাঝারি তীব্রতার ব্যায়াম করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যায়াম ট্রাইগ্লিসারাইড কমায় এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়।
ধূমপান ‘ভালো’ কোলেস্টেরল (HDL) কমিয়ে দেয়। ধূমপান ত্যাগ করলে HDL এর মাত্রা বাড়তে পারে।
ডা. পালের মতে, কোলেস্টেরল বেশি থাকলে অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো নির্দিষ্ট ওষুধ খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। বর্তমানে উন্নত ওষুধ রয়েছে যা খুব সহজেই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।
কোলেস্টেরল বাড়ার লক্ষণগুলি চিনতে পারলে আপনি আগে থেকেই সতর্ক হতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এই লক্ষণগুলি সবার ক্ষেত্রে একইভাবে দেখা নাও যেতে পারে। যেকোনো সন্দেহ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং রক্ত পরীক্ষা করান। নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ব্যায়াম করা, ধূমপান ত্যাগ করা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা – এই অভ্যাসগুলি আপনাকে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে।আমাদের স্বাস্থ্য আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই কোলেস্টেরল বাড়ার লক্ষণগুলি উপেক্ষা করবেন না। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন।