দক্ষিণ কলকাতার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে চরম বিতর্ক ও বিভাজন দেখা দিয়েছে। সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক মদন মিত্রের বিতর্কিত মন্তব্যের পর দলীয় নেতৃত্ব তাদের বক্তব্যের নিন্দা করে বিবৃতি জারি করলেও, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি দলের অবস্থানের বিরোধিতা করে পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছেন।
কসবা থানার এলাকায় অবস্থিত সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে গত ২৫ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত প্রায় একুশটা পর্যন্ত এক প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিতা ছাত্রী তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী এবং মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্রও একই সংগঠনের নেতা ছিলেন। ঘটনার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে কলেজের নিরাপত্তারক্ষী পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়কেও আটক করা হয়েছে।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর তৃণমূলের দুই প্রভাবশালী নেতা এমন মন্তব্য করেন যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বলেছিলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো আছেই। কিন্তু যদি একজন বন্ধু তাঁর বান্ধবীকে ধর্ষণ করে, সেখানে নিরাপত্তা কী করতে পারে?” পরবর্তীতে তিনি আরও কঠোর ভাষায় বলেন, “আইন না থাকলে এদের ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে গুলি করে মারা উচিত।”
অন্যদিকে কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র আরও বিতর্কিত মন্তব্য করে বসেন। তার মতে, “মেয়েটি ওখানে না গেলে এই ঘটনা ঘটত না। যদি যাওয়ার সময় কাউকে বলে যেত, ২ জন বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে যেত, তাহলে এই ঘটনা ঘটত না।” মদন মিত্র আরও যোগ করেন যে, অভিযুক্তরা “পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে” এবং এ ধরনের ঘটনা থেকে মেয়েদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।
দুই নেতার এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক মহলে। বিরোধী দলগুলো তৃণমূলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় এবং দাবি করে যে শাসক দলের এই মানসিকতাই নারী নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এমতাবস্থায় তৃণমূল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাৎক্ষণিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে নামে।
শনিবার তৃণমূল কংগ্রেস একটি বিবৃতি জারি করে জানায়, “সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনা প্রসঙ্গে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিধায়ক মদন মিত্র যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত। দল তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নয় এবং এই মন্তব্যগুলিকে কড়াভাবে নিন্দা করছে।” দলের বিবৃতিতে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়, “এই ধরনের বক্তব্য কোনওভাবেই দলের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না।”
তৃণমূলের নেতৃত্ব তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানায় যে মহিলাদের ওপর অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের “জিরো টলারেন্স নীতি” রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এই নীতি বহাল থাকবে। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তির দাবিও জানানো হয় দলীয় বিবৃতিতে।
কিন্তু দলের এই বিবৃতির মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক চমকপ্রদ পদক্ষেপ নেন। তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ পাল্টা পোস্ট করে লেখেন, “আমি তৃণমূলের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করছি। যাঁরা এই ধর্ষকদের আড়াল করছেন, ওঁরা কি পরোক্ষে সেই সব নেতাদের সমর্থন করছেন?”
কল্যাণের এই পাল্টা আক্রমণে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সংকট আরও গভীর হয়। তিনি আরও যোগ করেন, “এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সুশীল বিবৃতি দিয়ে কোনও পরিবর্তন হবে না। বরং অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে এখনই কড়া পদক্ষেপ করতে হবে।” তার বক্তব্যে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে দলের কিছু নেতা অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পরবর্তী পোস্টে আরও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি লেখেন, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ২০১১-এর পরে যে নেতারা উঠে এসেছেন (তৃণমূলে), এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তাঁদের নিয়েও প্রশ্ন আছে।” যদিও তিনি কোন নেতাদের কথা বলছেন তা স্পষ্ট করেননি, তবে এই মন্তব্য দলের অভ্যন্তরে নতুন মাত্রার বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে মদন মিত্র পরবর্তীতে কিছুটা নরম সুরে বলেন যে তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন যে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তৃণমূলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে তার মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে। মদন মিত্র দলীয় নেতৃত্বের কাছে আবেদন করেন যেন তাকে ভুল না বোঝা হয় এবং প্রয়োজনে তিনি যে কোনো তদন্তের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
এদিকে পুলিশি তদন্তে জানা গেছে যে নির্যাতিতার শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মেডিক্যাল রিপোর্টে তার গলায় কামড়ের দাগ, শরীরের বিভিন্ন স্থানে মারধরের চিহ্ন এবং যৌনাঙ্গে গুরুতর ক্ষতের প্রমাণ মিলেছে। ঘটনার সময় ধর্ষণের ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বিরোধী দলগুলো এই অভ্যন্তরীণ বিতর্ককে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আরও তীব্র আক্রমণ শানিয়েছে। বিজেপি নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন যে “কেন এমন লোক দলে থাকবেন?” একইসঙ্গে তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এই বিতর্ক তৃণমূলের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ করেছে।
কসবা কাণ্ডে তৃণমূলের এই অভ্যন্তরীণ বিভাজন রাজ্যের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একদিকে দলীয় নেতৃত্ব ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে প্রভাবশালী নেতাদের বিদ্রোহী অবস্থান দলের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে। আগামী দিনে এই সংকট কীভাবে মোকাবেলা করবে তৃণমূল, তা রাজ্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।