ভারতবর্ষ কেবল তার আধ্যাত্মিকতার জন্যই পরিচিত নয়, এটি এমন এক দেশ যেখানে প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে বিস্ময়কর রহস্য ও কিংবদন্তি। এই দেশের প্রাচীন মন্দিরগুলি কেবল উপাসনালয় নয়, সেগুলি যুগ যুগ ধরে স্থপতি, বিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকদের কাছে এক একটি অমীমাংসিত ধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কিছু মন্দির রয়েছে যার স্থাপত্যশৈলী আজকের আধুনিক প্রযুক্তিকেও চ্যালেঞ্জ জানায়, আবার কোথাও এমন সব ঘটনা ঘটে যা বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা কঠিন। এই নিবন্ধে, আমরা ভারতের শীর্ষ ৬টি এমন রহস্যময় মন্দির সম্পর্কে গভীরভাবে জানব, যেগুলির অলৌকিক ঘটনাবলী, স্থাপত্য কৌশল এবং অমীমাংসিত রহস্য আজও মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। এই মন্দিরগুলি পরিদর্শন করা কেবল একটি তীর্থযাত্রা নয়, বরং ভারতের অবিশ্বাস্য ইতিহাস এবং প্রকৌশল দক্ষতার সাক্ষী হওয়ার এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
ভারতবর্ষের এই মন্দিরগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু নয়, এগুলি প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও প্রতীক। ইউনেস্কো (UNESCO) কর্তৃক স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট থেকে শুরু করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়া স্থাপত্য—এই প্রতিটি মন্দিরই নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। কিছু মন্দিরের রহস্য তার নির্মাণ কৌশলের মধ্যে নিহিত, যেমন কীভাবে লক্ষ লক্ষ টন পাথর কেটে একটি সম্পূর্ণ মন্দির তৈরি করা হলো, আবার কিছু মন্দিরের রহস্য তার অলৌকিক প্রথা বা কিংবদন্তির সাথে জড়িত। আমরা এই মন্দিরগুলির পেছনের পৌরাণিক কাহিনী, ঐতিহাসিক তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলি অন্বেষণ করব, যা এগুলিকে ভারতের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম করে তুলেছে।
ভারতের শীর্ষ ৬টি রহস্যময় মন্দির: এক গভীর বিশ্লেষণ
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই মন্দিরগুলির প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব এক অবিশ্বাস্য কাহিনী, যা সাধারণ মানুষের কৌতূহলকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাড়িয়ে তুলেছে। চলুন, সেই রহস্যময় জগতের গভীরে প্রবেশ করা যাক।
১. শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির, কেরালা (Sri Padmanabhaswamy Temple, Kerala)
রহস্য: বন্ধ দরজা ‘ভল্ট বি’-এর আতঙ্ক
কেরালার তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি শুধুমাত্র ভারতের নয়, বিশ্বের অন্যতম ধনী মন্দির হিসেবে পরিচিত। ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গীকৃত এই মন্দিরটি দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন। তবে এই মন্দিরের মূল আকর্ষণ তার ঐশ্বর্য বা স্থাপত্য নয়, বরং এর গর্ভগৃহের নিচে থাকা ছয়টি গোপন ভল্ট (A, B, C, D, E, F)।
মন্দিরের এই রহস্যময় ভল্টগুলি কয়েক শতাব্দী ধরে বন্ধ ছিল। ২০১১ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এই ভল্টগুলি খোলার প্রক্রিয়া শুরু করে। একে একে পাঁচটি ভল্ট (A, C, D, E, F) খোলা হলে সেখান থেকে উদ্ধার হয় অবিশ্বাস্য পরিমাণ সোনা, হীরা, জহরত এবং প্রাচীন মুদ্রা, যার আনুমানিক মূল্য লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। এই আবিষ্কার মন্দিরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। কিন্তু সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ‘ভল্ট বি’ (Vault B), যা ‘মহাভারত কল্লরা’ নামেও পরিচিত।
কেন এই ভল্টটি এত রহস্যময়?
ভল্ট বি-এর মূল দরজাটি সম্পূর্ণ ইস্পাত দিয়ে তৈরি এবং এতে কোনো সাধারণ তালা বা কব্জা নেই। দরজার উপর খোদাই করা আছে দুটি বিশাল সাপের প্রতিকৃতি, যা এক অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। মন্দিরের পুরোহিত এবং স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, এই ভল্টটি ‘নাগ বন্ধনম’ বা সর্প মন্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত। বিশ্বাস করা হয় যে, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ‘গরুড় মন্ত্র’ উচ্চারণ করেই এই দরজা খোলা সম্ভব। বলপ্রয়োগ বা অন্য কোনো যান্ত্রিক উপায়ে এই দরজা খোলার চেষ্টা করলে তা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
মন্দিরের প্রাচীন নথি এবং ত্রাভাঙ্কোর রাজপরিবারের (Travancore Royal Family) ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, অতীতে কয়েকবার এই ভল্ট খোলার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই কিছু না কিছু অশুভ ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই ভল্টের ভিতরে কেবল ঐশ্বর্যই নয়, এমন কিছু অলৌকিক শক্তি বা প্রাচীন রহস্য লুকিয়ে আছে যা সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে। কিছু বিশেষজ্ঞের (Wikipedia reference) মতে, এই ভল্টের ভিতরে একটি ‘শ্রীচক্র’ বা বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা আছে যা মন্দিরের মূল দেবতাকে শক্তি জোগায় এবং এর ভারসাম্য নষ্ট হলে মন্দিরের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
এই ভল্ট খোলা উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে। একদল মনে করে, এর ভিতরে থাকা সম্পদ দেশের জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা উচিত। আরেক দল, বিশেষ করে রাজপরিবার ও ভক্তরা, বিশ্বাস করেন যে এই প্রাচীন বিশ্বাসকে সম্মান জানানো উচিত এবং ভল্টের রহস্যকে অমীমাংসিত রাখাই শ্রেয়। বর্তমানে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই ভল্টটি বন্ধই রাখা হয়েছে, যা পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে।
২. কৈলাস মন্দির, ইলোরা, মহারাষ্ট্র (Kailasa Temple, Ellora, Maharashtra)
রহস্য: একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরি অবিশ্বাস্য স্থাপত্য
মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ শহরের কাছে অবস্থিত ইলোরা গুহা একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (UNESCO World Heritage Site)। এখানে মোট ৩৪টি গুহা রয়েছে যা বৌদ্ধ, হিন্দু এবং জৈন ধর্মের নিদর্শন বহন করে। এই ৩৪টি গুহার মধ্যে ১৬ নম্বর গুহাটি হলো কৈলাস মন্দির, যা বিশ্বের স্থাপত্য ইতিহাসের এক জীবন্ত বিস্ময়।
কৈলাস মন্দিরের রহস্য তার নির্মাণশৈলীতে। এটি বিশ্বের একমাত্র মন্দির যা একটি মাত্র অখণ্ড শিলা (Monolithic Rock) কেটে তৈরি করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অন্যান্য মন্দিরের মতো এটি নিচ থেকে উপরে নয়, বরং পাহাড়ের চূড়া থেকে পাথর কেটে কেটে নিচের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, স্থপতিরা প্রথমে পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকে খোদাই করে মন্দিরের মূল কাঠামোটি বের করে এনেছেন এবং তারপর ভিতর ও বাহিরের সূক্ষ্ম কারুকার্য সম্পন্ন করেছেন।
অসম্ভব পরিসংখ্যান এবং কিছু প্রশ্ন:
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) এবং ঐতিহাসিকদের মতে, এই মন্দিরটি অষ্টম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম কৃষ্ণের (শাসনকাল আনুমানিক ৭৫৬-৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বকালে নির্মিত হয়েছিল। ব্রিটিশ মিউজিয়াম (Britannica reference) এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুযায়ী, এই মন্দিরটি নির্মাণ করতে আনুমানিক ১,৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ (কিছু মতে ৪,০০,০০০) টন কঠিন ব্যাসল্ট শিলা কেটে সরাতে হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় রহস্য হলো এর সময়কাল। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সুবিশাল এবং জটিল কাঠামোর মন্দিরটি নির্মাণ করতে মাত্র ১৮ বছর সময় লেগেছিল। আধুনিক প্রকৌশলীরা হিসাব করে দেখেছেন যে, ১৮ বছরে ৪ লক্ষ টন পাথর সরাতে হলে প্রতিদিন প্রায় ৬০ টন পাথর কাটতে হতো এবং তা বিরতিহীনভাবে। যদি শ্রমিকরা দিনে ১২ ঘণ্টাও কাজ করেন, তাহলেও প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫ টন পাথর কাটার প্রয়োজন, যা কেবল হাতুড়ি এবং ছেনির মতো প্রাচীন সরঞ্জাম দিয়ে প্রায় অসম্ভব।
এই অবিশ্বাস্য কীর্তি কীভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে কোনো লিখিত নথি বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
- নির্মাণ কৌশল: কীভাবে প্রাচীন স্থপতিরা এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করেছিলেন? একটি মাত্র ভুল গণনায় পুরো কাঠামোটি ভেঙে পড়তে পারতো।
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: লক্ষ লক্ষ টন কাটা পাথর কোথায় সরানো হলো? মন্দিরের আশেপাশে এর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
- সময়: মাত্র ১৮ বছরে এই অসাধ্য সাধন কীভাবে হলো?
কিছু তত্ত্ববিদ ভিনগ্রহের প্রাণীর সাহায্যে বা কোনো উন্নত প্রাচীন প্রযুক্তি (Lost Technology) ব্যবহারের কথা বললেও, বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন এটি ছিল মানুষের অধ্যাবসায়, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং অতুলনীয় দক্ষতার এক চরম নিদর্শন। কৈলাস মন্দির আজও প্রকৌশলীদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ, যা প্রমাণ করে যে প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য জ্ঞান আমাদের আধুনিক কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
৩. বীরভদ্র মন্দির, লেপাক্ষী, অন্ধ্রপ্রদেশ (Veerabhadra Temple, Lepakshi, Andhra Pradesh)
রহস্য: মাধ্যাকর্ষণকে হার মানানো ‘ঝুলন্ত স্তম্ভ’
অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলায় অবস্থিত লেপাক্ষী মন্দিরটি ষোড়শ শতকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। মন্দিরটি ভগবান শিবের উগ্র রূপ বীরভদ্রকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই মন্দিরে অনেক বিস্ময়কর জিনিস রয়েছে, যেমন বিশাল একশিলা নন্দীর মূর্তি (যা মূল মন্দির থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে অবস্থিত এবং ২৭ ফুট লম্বা), বিশাল নাগলিঙ্গ মূর্তি এবং ছাদের উপর সূক্ষ্ম ফ্রেস্কো পেইন্টিং। কিন্তু পর্যটক ও গবেষকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ হলো মন্দিরের ‘নাট্য মণ্ডপে’ (Dance Hall) থাকা একটি ‘ঝুলন্ত স্তম্ভ’ (Hanging Pillar)।
মন্দিরের এই মণ্ডপটিতে মোট ৭০টি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে। এর মধ্যে একটি স্তম্ভ ভূমি স্পর্শ করে না। এটি ছাদ থেকে ঝুলে আছে, তবে মাটি থেকে সামান্য উপরে। দর্শনার্থীরা অনায়াসে এই স্তম্ভের নিচ দিয়ে একটি পাতলা কাপড় বা কাগজের টুকরো একপাশ থেকে অন্যপাশে পার করতে পারেন ।
কিংবদন্তি বনাম প্রকৌশল:
কিংবদন্তি অনুসারে, মন্দিরের নির্মাণকারী দুই ভাই (বীরান্না ও বীরুপান্না) ভগবান শিবের প্রতি তাদের ভক্তি এবং স্থাপত্য দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য এই স্তম্ভটি ইচ্ছাকৃতভাবে এভাবে তৈরি করেছিলেন।
তবে এর পেছনের প্রকৌশলগত ব্যাখ্যা আরও চমকপ্রদ। ব্রিটিশ শাসনামলে, এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার এই স্তম্ভের রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি স্তম্ভটিকে তার স্থান থেকে সরানোর চেষ্টা করেন এই ভেবে যে এটি হয়তো ছাদের কোনো কাজে লাগছে না। কিন্তু তিনি স্তম্ভটিতে আঘাত করার সাথে সাথে মণ্ডপের ছাদের অন্যান্য স্তম্ভগুলি এবং ছাদের একাংশ কেঁপে ওঠে ও ফাটল ধরতে শুরু করে। এতে তিনি বুঝতে পারেন যে, এই স্তম্ভটি অপ্রয়োজনীয় নয়, বরং এটি ছাদের সম্পূর্ণ কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষা করছে। এটি একটি অত্যন্ত জটিল ‘ক্যান্টিলিভার বিম’ (Cantilever Beam) সিস্টেমের অংশ হতে পারে, যা ছাদের ওজন এমনভাবে বিতরণ করে যাতে এই একটি স্তম্ভের উপর কোনো উল্লম্ব চাপ (Vertical Load) না পড়ে।
এটি কি প্রাচীন স্থপতিদের ইচ্ছাকৃত এক চমক, নাকি নির্মাণগত কোনো ত্রুটি যা সময়ের সাথে সাথে এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে? বিশেষজ্ঞদের একাংশ (Reddit discussion reference) মনে করেন, এটি সম্ভবত একটি ইচ্ছাকৃত নির্মাণ। স্থপতিরা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে তারা মাধ্যাকর্ষণের নিয়মকে কতটা সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কারণ যাই হোক না কেন, লেপাক্ষীর এই ঝুলন্ত স্তম্ভটি প্রাচীন ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্রের এক অপার বিস্ময় হয়ে রয়েছে।
৪. কোণার্ক সূর্য মন্দির, ওড়িশা (Konark Sun Temple, Odisha)
রহস্য: কিংবদন্তির ভাসমান মূর্তি ও চৌম্বক শক্তি
ত্রয়োদশ শতকে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেব কর্তৃক নির্মিত ওড়িশার কোণার্ক সূর্য মন্দিরটি ইউনেস্কোর আরেকটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (UNESCO World Heritage Site)। মন্দিরটি সূর্যদেবকে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং এর সম্পূর্ণ কাঠামোটি একটি বিশাল রথের আদলে তৈরি। এই রথে রয়েছে ১২ জোড়া চাকা (যা ১২ মাস বা ২৪টি পক্ষকে বোঝায়) এবং একে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ৭টি শক্তিশালী ঘোড়া (যা সপ্তাহের ৭ দিনকে বোঝায়)।
মন্দিরের প্রতিটি চাকা একেকটি সূর্যঘড়ি (Sundial) হিসেবে কাজ করে, যা আজও প্রায় নিখুঁতভাবে সময় বলে দিতে পারে। কিন্তু এই মন্দিরের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে তার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মূল শিখর বা ‘বিমান’-এর কিংবদন্তিতে।
চুম্বকের কিংবদন্তি:
জনশ্রুতি আছে, মন্দিরের মূল শিখরটি প্রায় ২২৯ ফুট (৭০ মিটার) উঁচু ছিল। এই শিখরের শীর্ষে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ৫২ টনের চুম্বক পাথর বা ‘লোডস্টোন’ (Lodestone) স্থাপন করা হয়েছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহে থাকা সূর্যদেবের মূর্তিটি ছিল একটি বিশেষ ধাতব সংকর দিয়ে তৈরি (অথবা শূন্যে ভাসমান)। কিংবদন্তি অনুসারে, মন্দিরের শিখরের মূল চুম্বক এবং মন্দিরের ভিত্তির নিচে থাকা আরেকটি শক্তিশালী চুম্বকের চৌম্বকীয় আকর্ষণের ফলে মূল বিগ্রহটি শূন্যে ভেসে থাকত।
এই চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে, মন্দিরের কাছাকাছি সমুদ্র দিয়ে যাওয়া জাহাজগুলির কম্পাস বা দিকনির্ণয় যন্ত্র ভুল দিকে নির্দেশ করতে শুরু করে। ঐতিহাসিক সূত্র (Wikipedia reference) এবং স্থানীয় লোককাহিনী অনুসারে, পর্তুগিজ নাবিকরা (বা মতান্তরে, কালাপাহাড়) এই চৌম্বকীয় শক্তির কারণে বারবার সমুদ্রপথে বিভ্রান্ত হচ্ছিলেন। জাহাজগুলিকে রক্ষা করার জন্য, তারা মন্দিরের চূড়া থেকে সেই মূল চুম্বকটি সরিয়ে নেয় বা ধ্বংস করে দেয়।
বিশ্বাস করা হয়, এই মূল চুম্বকটি সরিয়ে ফেলার ফলেই মন্দিরের দেয়ালের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। কারণ মূল চুম্বকটি অন্যান্য দেয়ালের পাথরগুলিকেও একটি নির্দিষ্ট চৌম্বকীয় বন্ধনে ধরে রেখেছিল। এর ফলেই মন্দিরের মূল শিখরটি ধসে পড়ে।
বাস্তবতা কী?
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI) এই চুম্বকের তত্ত্বকে সরাসরি সমর্থন করে না। তাদের মতে, মন্দিরের এত উঁচু শিখরটি সম্ভবত তার নিজের ওজনের ভারে বা ভূমিকম্পের কারণে অথবা দুর্বল খন্ডালাইট (Khondalite) পাথরের ক্ষয়ের কারণে সময়ের সাথে সাথে ভেঙে পড়েছে। যা-ই হোক না কেন, কীভাবে ত্রয়োদশ শতকে এমন সুউচ্চ এবং নিখুঁত একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল এবং কেনই বা তা ধসে পড়ল, সেই রহস্য আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।
৫. কামাখ্যা মন্দির, আসাম (Kamakhya Temple, Assam)
রহস্য: ‘রজঃস্বলা দেবী’ এবং অম্বুবাচী মেলা
আসামের গুয়াহাটিতে নীলাচল পাহাড়ের উপরে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং শক্তিশালী ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে একটি। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এখানে দেবী সতীর যোনি বা গর্ভ পতিত হয়েছিল। এই মন্দিরটি তন্ত্র সাধনার এক প্রধান কেন্দ্র।
কামাখ্যা মন্দিরের প্রধান রহস্য অন্য যেকোনো মন্দির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে কোনো দেবীর মূর্তি বা বিগ্রহ নেই। এখানে পূজা করা হয় একটি যোনি-আকৃতির শিলাকে, যা থেকে প্রাকৃতিকভাবে একটি ঝর্ণার জল বেরিয়ে আসে।
অম্বুবাচী মেলা ও ‘রক্তবস্ত্র’:
প্রতি বছর আষাঢ় মাসে (সাধারণত জুন মাসের ২২ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে) এখানে অম্বুবাচী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়টিকে ‘পূর্বের মহাকুম্ভ’ বলা হয়, যখন লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও সাধু-সন্ন্যাসীর সমাগম ঘটে।
বিশ্বাস করা হয়, এই তিন দিন দেবী কামাখ্যা ঋতুমতী হন বা রজঃস্বলা হন। এই সময় মন্দিরের দরজা সাধারণ ভক্তদের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এই তিন দিন মন্দিরের ভিতরের সেই প্রাকৃতিক ঝর্ণার জল নাকি অলৌকিকভাবে লাল বর্ণ ধারণ করে।
বিশ্বাস বনাম বিজ্ঞান:
- বিশ্বাস: ভক্তদের মতে, এটি দেবীর ঋতুস্রাব। মন্দিরের দরজা খোলার পর, ভক্তদের প্রসাদ হিসেবে ‘রক্তবস্ত্র’ বা ‘অঙ্গবস্ত্র’ দেওয়া হয়—সাদা কাপড় যা দেবীর এই ‘রক্তে’ ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল। এই বস্ত্রকে অত্যন্ত পবিত্র এবং অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করা হয়।
- বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: বিজ্ঞানীরা বা যুক্তিবাদীরা মনে করেন, এই লাল রঙের কারণ হতে পারে শিলার মধ্যে থাকা উচ্চ মাত্রার আয়রন অক্সাইড (মরিচা) বা সিনাবার (Cinnabar)। অথবা, এই প্রথাকে বজায় রাখার জন্য পুরোহিতরা এই সময়ে জলে সিঁদুর বা কুমকুম মিশিয়ে থাকতে পারেন।
কারণ যাই হোক না কেন, কামাখ্যা মন্দিরের এই প্রথাটি এক অনন্য সামাজিক বার্তাও বহন করে। শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম StudyIQ (StudyIQ article) যেমন উল্লেখ করেছে, ভারতে যেখানে ঋতুস্রাবকে প্রায়শই ‘অপবিত্র’ বা অশুচি বলে মনে করা হয়, সেখানে কামাখ্যা মন্দিরই একমাত্র স্থান যা নারীত্বের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে পবিত্র বলে উদযাপন করে এবং তাকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন করে। এটি নারীশক্তির আরাধনার এক চূড়ান্ত নিদর্শন।
৬. করনি মাতা মন্দির, রাজস্থান (Karni Mata Temple, Rajasthan)
রহস্য: ২৫,০০০ ইঁদুরের পবিত্র আবাস
রাজস্থানের বিকানের থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে দেশনোক শহরে অবস্থিত করনি মাতা মন্দিরটি ‘ইঁদুরের মন্দির’ (Temple of Rats) নামে বিশ্বখ্যাত। এই মন্দিরে দেবী করনি মাতার পূজা করা হয়, যিনি চতুর্দশ শতাব্দীর এক মরমী সাধিকা এবং মা দুর্গার অবতার হিসেবে পূজিত হন।
এই মন্দিরের মূল বিস্ময় হলো এখানে বসবাসকারী প্রায় ২৫,০০০-এরও বেশি ইঁদুর। এই ইঁদুরগুলিকে এখানে ‘কাব্বা’ (Kabbas) বলা হয় এবং ভক্তরা এদের পবিত্র জ্ঞানে পূজা করেন।
ইঁদুরের পেছনের কিংবদন্তি:
দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের (The Financial Express BD) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিটি হলো করনি মাতার পুত্র লক্ষণের। একদিন লক্ষণ পার্শ্ববর্তী কপিল সরোবরে জল খেতে গিয়ে ডুবে মারা যান। করনি মাতা তার সন্তানকে হারানোর শোকে মৃত্যর দেবতা যমরাজের কাছে তার পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা করেন। যমরাজ প্রথমে রাজি না হলেও, করনি মাতার অনুনয়ে অবশেষে তিনি লক্ষণের প্রাণ ফিরিয়ে দেন, তবে একটি শর্তে। তিনি বলেন যে, করনি মাতার বংশধরেরা (চারন সম্প্রদায়) মৃত্যুর পর যমলোকে যাবে না, বরং তারা ইঁদুর রূপে পুনর্জন্ম নেবে এবং এই মন্দিরেই বাস করবে। পরবর্তী জন্মে তারা আবার মানুষ হয়ে জন্মাবে।
অলৌকিক বিশ্বাস ও প্রথা:
- সাদা ইঁদুরের দর্শন: মন্দিরের হাজার হাজার কালো বা বাদামী ইঁদুরের মধ্যে কয়েকটি বিরল সাদা ইঁদুরও রয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, এই সাদা ইঁদুরগুলি স্বয়ং করনি মাতা বা তার পুত্রদের সাক্ষাৎ অবতার। মন্দিরে সাদা ইঁদুরের দর্শন পাওয়াকে অত্যন্ত সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
- প্লেগের অনুপস্থিতি: সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক বিস্ময় হলো, হাজার হাজার ইঁদুর এবং ভক্তদের এমন ঘনিষ্ঠ সহাবস্থান সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত দেশনোক বা মন্দিরের আশেপাশে প্লেগের মতো ইঁদুরবাহিত কোনো বড় মহামারীর খবর পাওয়া যায়নি।
- পবিত্র প্রসাদ: ভক্তরা ইঁদুরের জন্য দুধ, মিষ্টি এবং অন্যান্য খাবার নিয়ে আসেন। ইঁদুরদের খাওয়া উচ্ছিষ্ট খাবারকেই ভক্তরা ‘মহাপ্রসাদ’ হিসেবে গ্রহণ করেন, যা তাদের আরোগ্য এবং সৌভাগ্য এনে দেয় বলে বিশ্বাস।
- প্রায়শ্চিত্ত: মন্দিরে ইঁদুরদের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। যদি কোনো ভক্তের অসাবধানতায় একটি ইঁদুর মারা যায়, তবে তাকে শাস্তি হিসেবে ওই মৃত ইঁদুরের ওজনের সমপরিমাণ সোনা বা রূপার একটি ইঁদুরের মূর্তি মন্দিরে দান করতে হয়।
করনি মাতা মন্দির হলো বিশ্বাস এবং সহাবস্থানের এক চরম উদাহরণ, যেখানে মানুষ এবং ইঁদুর একই ছাদের নিচে একে অপরের বিশ্বাসকে সম্মান জানিয়ে বসবাস করে, যা আধুনিক বিশ্বের কাছে এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত।
ভারতের এই ছয়টি মন্দির প্রমাণ করে যে এই দেশ কেবল আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র নয়, এটি এক জীবন্ত রহস্যের ভাণ্ডার। শ্রী পদ্মনাভস্বামীর বন্ধ দরজা থেকে শুরু করে কৈলাস মন্দিরের অবিশ্বাস্য প্রকৌশল, লেপাক্ষীর মাধ্যাকর্ষণ-বিরোধী স্তম্ভ থেকে কোণার্কের চৌম্বক কিংবদন্তি, এবং কামাখ্যার অলৌকিক প্রথা থেকে করনি মাতার পবিত্র ইঁদুর—প্রতিটি কাহিনীই আমাদের পরিচিত যুক্তি এবং বিজ্ঞানের সীমানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এই মন্দিরগুলি প্রাচীন ভারতীয়দের জ্ঞান, তাদের স্থাপত্য দক্ষতা এবং প্রকৃতির সাথে তাদের গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগের এক একটি নীরব সাক্ষী। আপনি একজন ভক্ত, একজন ইতিহাসবিদ, একজন স্থপতি বা কেবল একজন কৌতূহলী পর্যটক যা-ই হোন না কেন, ভারতের এই রহস্যময় মন্দিরগুলি আপনাকে চিরকাল বিস্মিত এবং মুগ্ধ করে রাখবে। এগুলি কেবল উপাসনালয় নয়, এগুলি ভারতের সেই সমৃদ্ধ অতীতের জীবন্ত দলিল, যার অনেক কিছুই আজও আমাদের অনাবিষ্কৃত এবং অজানা রয়ে গেছে।