Bangladesh Flood Update: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ বন্যার্ত এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন। তাঁদের অধিকাংশই দাবি করছেন, তাঁরা বন্যার্তদের সাহায্য করতে এসেছেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। অনেকেই এসেছেন শুধুমাত্র সেলফি তুলতে বা বন্যার দৃশ্য দেখতে। এই ঘটনা ঘটছে মূলত কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর প্রভৃতি জেলায়।
বন্যার্ত এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে এই অপ্রত্যাশিত “পর্যটক”দের ভিড়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই ভিড় তাঁদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ খাবার ও পানীয় জল এই “পর্যটক”রা ব্যবহার করছেন, যা স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন, জানিয়েছেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি যে গত কয়েকদিনে বন্যার্ত এলাকায় পর্যটকদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এটা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। আমরা মানুষকে অনুরোধ করছি যে তারা যেন এই মুহূর্তে বন্যার্ত এলাকায় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকেন।”
Bangladesh Flood: বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ, ৩৬ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন,
কুড়িগ্রামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ আব্দুল করিম বলেন, “আমরা যখন খাবার ও পানীয় জলের জন্য হাহাকার করছি, তখন এই তথাকথিত পর্যটকরা এসে আমাদের জন্য বরাদ্দ সাহায্য ব্যবহার করছে। এটা খুবই দুঃখজনক।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বন্যায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, অপ্রয়োজনীয় ভিড় পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
সামাজিক মিডিয়ায় এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই এই ধরনের আচরণকে নিন্দা করেছেন। ফেসবুক ব্যবহারকারী সাদিয়া আহমেদ লিখেছেন, “বন্যার্তদের দুর্দশাকে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে শোভা পাওয়ার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা কতটা নীতিগত? আমরা কি এতটাই অমানবিক হয়ে গেছি?”
এই ঘটনার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, এই ধরনের আচরণ শুধু বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টি করছে না, একই সঙ্গে সামাজিক সংহতি ও মূল্যবোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুন নাহার বলেন, “এই ঘটনা আমাদের সমাজের একটি গভীর সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। আমরা ক্রমশ সংবেদনশীলতা হারাচ্ছি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক ও শেয়ারের জন্য অন্যের দুর্দশাকে ব্যবহার করতে দ্বিধা করছি না। এটা একটি চিন্তার বিষয়।”
বাংলাদেশ সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, “যারা শুধুমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বন্যার্ত এলাকায় যাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সকলকে অনুরোধ করছি, এই সংকটময় মুহূর্তে দয়া করে বন্যার্ত এলাকায় অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন।”
এদিকে, বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে। তারা বন্যার্ত এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম শুরু করেছে। ব্র্যাক-এর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা মানুষকে বুঝিয়ে বলছি যে এই মুহূর্তে বন্যার্ত এলাকায় যাওয়া কতটা ক্ষতিকর হতে পারে। পরিবর্তে, আমরা তাদের অনুরোধ করছি যে তারা যেন প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে আমাদের মাধ্যমে পাঠান।”
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের বন্যা আগামীতে আরও ঘন ঘন হতে পারে। তাই, এখনই সময় এসেছে যে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের মানসিকতা ও আচরণ পরিবর্তন করি।
জলবায়ু গবেষক ড. আইনুন নিশাত বলেন, “গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা ও ঘনত্ব বাড়ছে। আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে। এবং সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমাদের শিখতে হবে কীভাবে দুর্যোগকালীন সময়ে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি, না করে বরং কীভাবে বাধা সৃষ্টি করি।”
সামাজিক মিডিয়ায় এই ঘটনা নিয়ে একটি নতুন হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে: #নোসেলফিইনবন্যা। এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে মানুষ অন্যদের অনুরোধ করছেন যে তারা যেন বন্যার্ত এলাকায় শুধুমাত্র সেলফি তোলার জন্য না যান।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফ বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি যে মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের প্রাথমিকতা হওয়া উচিত বন্যার্তদের সাহায্য করা। আমরা সকলকে অনুরোধ করছি, দয়া করে এই মুহূর্তে বন্যার্ত এলাকায় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন।”
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্যোগকালীন আচরণবিধি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখানো যাবে কীভাবে দুর্যোগের সময় দায়িত্বশীল আচরণ করতে হয়।
Assam Floods: কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে বন্যার তাণ্ডব, ১২৯টি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু
শিক্ষাবিদ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমাদের পাঠ্যক্রমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর মাধ্যমে আমরা আগামী প্রজন্মকে শিখাতে পারব কীভাবে সংকটের সময় একে অপরকে সাহায্য করতে হয়।”
শেষ পর্যন্ত, এই ঘটনা আমাদের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে: আমরা কি সত্যিই অন্যের দুঃখ-দুর্দশায় সহানুভূতিশীল, নাকি শুধুই নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে একটি ভাইরাল পোস্ট করার জন্য উৎসুক? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের সমাজের গভীরে তাকাতে হবে।সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের আচরণের পেছনে রয়েছে আমাদের সমাজের ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে, অনেকেই নিজেদের অনলাইন ইমেজ তৈরি ও বজায় রাখতে ব্যস্ত। এই প্রক্রিয়ায়, তারা অনেক সময় ভুলে যান যে তাদের কাজের প্রভাব অন্যদের উপর কী হতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীন ইসলাম বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ার অতিব্যবহার আমাদের সহানুভূতিশীলতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা ক্রমশ বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি এবং অনলাইন জগতে বেশি সময় কাটাচ্ছি।
এর ফলে, আমরা অন্যের দুঃখ-কষ্টকে যথাযথভাবে অনুভব করতে পারছি না।”এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলি একযোগে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে বন্যার্ত এলাকায় অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ কতটা ক্ষতিকর হতে পারে।দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করছি। এছাড়াও, আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে তারা বন্যার্ত এলাকায় অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে।”এদিকে, কিছু যুব সংগঠন এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালাচ্ছে যাতে মানুষ বন্যার্ত এলাকায় না গিয়ে বরং ত্রাণ সংগ্রহে সহায়তা করে।