বেঙ্গালুরুতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর (আরসিবি) প্রথম আইপিএল ট্রফি জয়ের উদযাপন পরিণত হয়েছিল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১১ জন সমর্থক, আহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। এই ঘটনায় গোটা দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে, প্রশ্ন উঠেছে আয়োজক ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। ঘটনার পর আরসিবি, অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও কর্নাটক সরকারের পক্ষ থেকে শোকপ্রকাশ ও ক্ষতিপূরণের ঘোষণা এসেছে।
এই দুর্ঘটনার মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত ভিড় ও নিরাপত্তার ঘাটতি। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে লক্ষাধিক সমর্থক জমায়েত হন কোহলিদের প্রথম আইপিএল ট্রফি হাতে দেখার জন্য। স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা যেখানে মাত্র ৩৫,০০০, সেখানে দুই থেকে তিন লক্ষ মানুষ ভিড় করেছিলেন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেট বন্ধ করে দিলে, বাইরে অপেক্ষমাণ মানুষের চাপে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। অনেকে গেট টপকাতে, গাড়ির ছাদে উঠতে, গাছ বেয়ে উঠতে থাকেন। এক পর্যায়ে গেটের সামনে ভিড়ের চাপে অনেকে পড়ে যান এবং পদপিষ্ট হন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে আতঙ্কের চিত্র। কেউ কেউ জানান, পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করলেও, ভিড়ের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে তা কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আহতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তরুণ-তরুণী, এমনকি ১৪ বছরের এক কিশোরীও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন। আহতদের দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে।
ঘটনার পরও স্টেডিয়ামের ভিতরে চলতে থাকে আরসিবির বিজয় উৎসব। তবে কিছুক্ষণ পর আয়োজকরা পরিস্থিতি বুঝে সংক্ষিপ্ত করে দেন অনুষ্ঠান। আরসিবি ও কর্নাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ) দ্রুত বিবৃতি প্রকাশ করে গভীর শোকপ্রকাশ করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে যথাক্রমে ৫ ও ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেন। কর্নাটক সরকারও মৃতদের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়ার কথা জানায়। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া জানান, “এই মর্মান্তিক ঘটনা কখনও ঘটতে দেওয়া উচিত ছিল না। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি”।
বিরাট কোহলি নিজের প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, “ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।” তিনি আরও বলেন, এমন সাফল্যের মুহূর্তে এই ধরনের শোকাবহ ঘটনা দলের সকল সদস্যকে মর্মাহত করেছে। আরসিবি-র অফিসিয়াল বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, “সমস্ত সমর্থকদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা আমাদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ মেনে দ্রুত কর্মসূচি পরিবর্তন করেছি এবং সকলকে নিরাপদে থাকার অনুরোধ করছি”।
দুর্ঘটনার পর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে ছিল স্থানীয় প্রশাসন ও আরসিবি-র উপর। বিসিসিআই-র সচিব দেবজিৎ শইকীয়া বলেন, “এ ধরনের বড় আয়োজনের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। আয়োজকদের আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা করা উচিত ছিল”।
প্রসঙ্গত, এই বিজয় উৎসবের জন্য আগে থেকেই হুডখোলা বাস প্যারেডের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু যানজট ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণে সেটি বাতিল করা হয়। এরপরও স্টেডিয়ামের বাইরে বিপুল জনসমাগম ঘটে। পাস বিতরণের ক্ষেত্রে ‘আগে আসুন, আগে পান’ নীতির ফলে সকাল থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ গেট বন্ধ করে দিলে, উত্তেজনা চরমে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত ঘটে যায় এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
এই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শোক ও সমবেদনার বার্তা এসেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও টুইট করে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। ক্রিকেট মহলেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে; শচীন তেন্ডুলকার-সহ অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে শোকবার্তা দিয়েছেন।
এই দুর্ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কর্নাটক সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ১৫ দিনের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে এ ধরনের বড় আয়োজনের ক্ষেত্রে আরও কড়া নিরাপত্তা ও পরিকল্পনার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
সবশেষে বলা যায়, ১৮ বছরের অপেক্ষার অবসানে আরসিবি-র প্রথম আইপিএল ট্রফি জয় যেমন কোটি সমর্থকের আনন্দের কারণ হয়েছিল, তেমনি উদযাপনের মুহূর্তেই ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা গোটা উৎসবকে ঢেকে দিয়েছে গভীর বিষাদে। প্রশাসনের নজরদারি ও আয়োজকদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা ছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়—এ কথা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।