কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে আর নীল আকাশ দেখা যায় না। ধোঁয়াশা আর ধুলোয় ঢাকা আকাশ যেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। গত এক দশক ধরে তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসনে রাজ্যের পরিবেশ কী সত্যিই ধ্বংসের মুখে? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ? আসুন খুঁজে বের করি সত্যটা।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিদৃশ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাব অনস্বীকার্য। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দলটি রাজ্যের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১৫টিতে জয়লাভ করে তৃণমূল তাদের শক্তিশালী অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছে।
কিন্তু এই রাজনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি রাজ্যের পরিবেশগত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২৪ সালের একটি সরকারি অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন রূপায়ণে গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। কলকাতা, দুর্গাপুর, আসানসোল ও হলদিয়ার মতো ইতিমধ্যেই উচ্চমাত্রায় দূষিত এলাকায় অতিরিক্ত দূষণকারী শিল্প স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা পরিবেশগত নীতি লঙ্ঘনের সমান।
গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় ৩৭৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত দূষণ সৃষ্টি করছে। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৫-১৬ সময়কালে হলদিয়ার বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্রে ৬৬ থেকে ৭৭ শতাংশ ক্ষতিকর বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া, পরিবেশগত দিক থেকে স্পর্শকাতর এলাকাগুলোকেও শিল্প স্থাপনের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি।
তবে সমস্যার মূলে শুধু সরকারি নীতি নয়, মানবসম্পদের অভাবও রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলায় মাত্র ১১টি আঞ্চলিক দপ্তর রয়েছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। মাত্র ৩৯ জন কারিগরি আধিকারিকের ওপর ৪৭,৮৯৪টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নজরদারির দায়িত্ব ন্যস্ত, যার মধ্যে ৫,৪৫২টি অত্যন্ত দূষণকারী রেড ক্যাটাগরি শিল্প রয়েছে।
অন্যদিকে, তৃণমূল সরকার দাবি করছে তারা পরিবেশ সংরক্ষণে সচেষ্ট। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার ঘোষণা করেছে, সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড় ও বায়ু দূষণের সমস্যা মোকাবিলায় নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগের বাস্তব প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরিবেশ সংরক্ষণের চেয়ে ভোট রাজনীতি অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে সরকারের কাছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে মুসলিম ভোট ব্যাংক ধরে রাখতে তৃণমূল বিশেষ তৎপর। এই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ফলে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি পেছনে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
তবে বিরোধীরা যতটা অভিযোগ করছেন, বাস্তব চিত্র তার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র ক্ষমতা কি পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলছে?
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তৃণমূল কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসন কি রাজ্যের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, নাকি এটি আরও অবনতির দিকে নিয়ে গেছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করব।
তৃণমূলের শাসনে অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক চিত্রে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GSDP) বৃদ্ধি পেয়েছে এবং রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি কমেছে। ২০১১-১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের GSDP ছিল ষষ্ঠ স্থানে, যা ২০১৮-১৯ সালেও একই স্থানে ছিল। রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতি ২০১০-১১ সালের ৩.৭৫ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ সালে ০.৯২ শতাংশে নেমে এসেছে।
কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২০১১-১৯ সময়কালে কৃষি খাতে ৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের গড় বৃদ্ধির দ্বিগুণ। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির মাধ্যমে দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে এবং গ্রামীণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
চাকরি প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে পশ্চিমবঙ্গ: অপেক্ষায় বেকার যুবসমাজ
শিল্প ও বিনিয়োগ:
তবে, শিল্প খাতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ততটা ভালো নয়। স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্যের শিল্প উৎপাদনের শেয়ার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উৎপাদনের শেয়ার ছিল ১১.৬ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৫.৯ শতাংশে নেমে এসেছে[6]। এছাড়া, রাজ্যে বিদেশি বিনিয়োগের হারও কম। ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিদেশি বিনিয়োগের শেয়ার ছিল মাত্র ১ শতাংশ।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও উঠেছে। “কাট মানি” এবং “সিন্ডিকেট” এর মতো দুর্নীতির মডেলগুলি রাজ্যের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে প্রভাবিত করেছে। এই ধরনের দুর্নীতি শিল্প ও ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সামাজিক উন্নয়ন:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে সামাজিক সেবা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কল্যাণ ইত্যাদি খাতে রাজ্যের মোট ব্যয়ের শেয়ার ২০১০-১১ সালের ৯.৮ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ সালে ১৯.৪২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে এবং সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে কোন খাতে সফল উন্নয়ন হয়েছে?
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা বিশ্লেষণ করব, তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে কোন কোন খাতে সফল উন্নয়ন হয়েছে এবং কীভাবে এই উন্নয়ন রাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।
কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২০১১-১৯ সময়কালে কৃষি খাতে ৩.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের গড় বৃদ্ধির দ্বিগুণ[2]। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির মাধ্যমে দরিদ্রতা হ্রাস পেয়েছে এবং গ্রামীণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। “কৃষক বন্ধু” এবং “কন্যাশ্রী” প্রকল্পগুলি গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
সামাজিক কল্যাণ ও স্বাস্থ্য:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে সামাজিক সেবা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কল্যাণ ইত্যাদি খাতে রাজ্যের মোট ব্যয়ের শেয়ার ২০১০-১১ সালের ৯.৮ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ সালে ১৯.৪২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে[8]। “স্বাস্থ্যসাথী” প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের সাধারণ মানুষ বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন, যা স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে অবকাঠামো খাতেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। রাজ্যের মূলধন ব্যয় ২০১০-১১ সালের ₹২,৬৩৩ কোটি থেকে ২০২২-২৩ সালে ₹২২,৭৫৩ কোটি হয়েছে[5]। রাস্তা, সেতু, এবং অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।
নারী ক্ষমতায়ন:
তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনামলে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। “কন্যাশ্রী” এবং “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার” প্রকল্পগুলি নারীদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক হয়েছে। “কন্যাশ্রী” প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষাধিক মেয়ে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে এবং “লক্ষ্মীর ভাণ্ডার” প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহিণীদের মাসিক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
রপ্তানি ও বাণিজ্য:
পশ্চিমবঙ্গের রপ্তানি খাতেও উন্নতি হয়েছে। ২০১০-১১ সালে রাজ্যের রপ্তানি ছিল ₹৫৫,৫৮৯ কোটি, যা ২০২১-২২ সালে ₹১.১ লক্ষ কোটি হয়েছে[5]। রাজ্য সরকার “পশ্চিমবঙ্গ রপ্তানি প্রচার নীতি” এবং “পশ্চিমবঙ্গ লজিস্টিক সেক্টর উন্নয়ন নীতি” গ্রহণ করেছে, যা রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশগত সমস্যা নিঃসন্দেহে গুরুতর। তবে এর জন্য শুধুমাত্র তৃণমূল সরকারকে দায়ী করা যায় না। দীর্ঘদিনের অবহেলা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন – এসব কারণও সমানভাবে দায়ী। তবে সরকার হিসেবে তৃণমূলের দায়িত্ব রয়েছে এই সমস্যাগুলো সমাধানে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধন করতে পারলেই কেবল পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। প্রশ্ন থেকে যায়, তৃণমূল সরকার কি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে?