Tripura AIDS Control Society HIV statistics: ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার একটি স্কুলের ক্লাসরুমে বসে আছে ১৬ বছরের রাজু। তার চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ। গত মাসে তার রক্তে HIV পজিটিভ ধরা পড়েছে। রাজুর মতো আরও শত শত শিক্ষার্থী আজ HIV আক্রান্ত। ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়া এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কি তবে মহামারীর রূপ নিচ্ছে?
ত্রিপুরা রাজ্য এইডস নিয়ন্ত্রণ সমিতির (TSACS) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ৮২৮ জন শিক্ষার্থী HIV পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ৫৭২ জন শিক্ষার্থী জীবিত রয়েছে। এই পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
TSACS-এর জয়েন্ট ডিরেক্টর জানিয়েছেন, রাজ্যের ২২০টি স্কুল এবং ২৪টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবনের প্রবণতা দেখা গেছে। এই তথ্য রাজ্যের ১৬৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
TSACS-এর পরিচালক ডাঃ সমর্পিতা দত্ত জানিয়েছেন, ত্রিপুরায় প্রতি বছর গড়ে ১,৫০০ নতুন HIV/AIDS কেস নথিভুক্ত হচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত রাজ্যে মোট ৮,৭২৯ জন HIV আক্রান্ত ব্যক্তি চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে ৫,৬৭৪ জন জীবিত রয়েছে। এদের মধ্যে ৪,৫৭০ জন পুরুষ, ১,১০৩ জন মহিলা এবং ১ জন ট্রান্সজেন্ডার রয়েছে।
উদ্বেগজনক বিষয় হল, HIV আক্রান্তদের মধ্যে যুবক ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবন। TSACS-এর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ত্রিপুরায় নথিভুক্ত ইনজেকশন মাদক সেবনকারীদের ৮৭% বয়স ১৬-৩০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১-২৫ বছর বয়সী, যারা মোট মাদক সেবনকারীদের ৪৩.৫% গঠন করে। উদ্বেগজনকভাবে ১৫ বছরের কম বয়সী ১২ জন শিশুও ইনজেকশন মাদক সেবনে অভ্যস্ত বলে জানা গেছে।
করোনা মহামারীর আগে (২০১৫-২০২০) ইনজেকশন মাদক সেবনের হার ছিল ৫%। কিন্তু করোনার পর (২০২০-২০২৩) এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০%। ফলস্বরূপ HIV পজিটিভিটি রেট ১৯৯৯ সালের ০.৫৬% থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ সালে ০.৯২% হয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ১,৭৯০ জন HIV পজিটিভ রোগী চিহ্নিত হয়েছে।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি মাসে ১৫০-২০০ জন নতুন করে HIV আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সকল স্কুলে প্রতি সপ্তাহে একটি বিশেষ সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের HIV/AIDS ও মাদকাসক্তি সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালক এন সি শর্মা সকল স্কুলকে ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি ও TSACS-এর বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় কাউন্সেলিং সেশন আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন।
TSACS-এর পরিচালক ডাঃ সমর্পিতা দত্ত জানিয়েছেন, “HIV সংক্রমণ এখানে নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬ সালে আমাদের প্রথম কেস ধরা পড়ে। তখন থেকেই TSACS HIV/AIDS নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। আমরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে টার্গেট করি, বিনামূল্যে চিকিৎসা দিই, সচেতনতা প্রচার করি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং করি। আমাদের ১৫৪টি কেন্দ্র রয়েছে যেখানে HIV পরীক্ষা ও কাউন্সেলিং করা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “HIV/AIDS বাতাস বা জলের মাধ্যমে ছড়ায় না। এটি গর্ভবতী মহিলা, সংক্রমিত রক্ত, ইনজেকশন মাদক ও সুই শেয়ার করার মাধ্যমে ছড়াতে পারে। আমরা ১৪টি বিভাগের সাথে কাজ করছি এই রোগের সামাজিক কলঙ্ক দূর করতে।”
পরিস্থিতি যতই জটিল হোক না কেন, আশার আলো রয়েছে। সঠিক চিকিৎসা ও সচেতনতার মাধ্যমে HIV নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজু ও তার মতো অন্যান্য শিক্ষার্থীরা যদি সময়মত চিকিৎসা পান এবং সমাজ তাদের সহযোগিতা করে, তবে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু সরকারি প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রয়াস। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই ত্রিপুরাকে HIV মুক্ত করা সম্ভব হবে
ত্রিপুরায় এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার প্রধান কারণগুচ্ছ
ত্রিপুরায় এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার প্রধান কারণগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রধানত ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবন, যৌন সংস্পর্শ, এবং সংক্রমিত রক্ত ও রক্তজাত পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে এই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
প্রধান কারণসমূহ
১. ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবন
ত্রিপুরায় এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণ হিসেবে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ত্রিপুরা স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটির (TSACS) তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের ৮৭% ইনজেকশন মাদক সেবনকারী ১৬-৩০ বছর বয়সী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১-২৫ বছর বয়সী, যারা মোট মাদক সেবনকারীদের ৪৩.৫% গঠন করে। উদ্বেগজনকভাবে ১৫ বছরের কম বয়সী ১২ জন শিশুও ইনজেকশন মাদক সেবনে অভ্যস্ত বলে জানা গেছে।
২. যৌন সংস্পর্শ
যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমণ একটি সাধারণ কারণ। ত্রিপুরায় যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমণের হারও উদ্বেগজনক। বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী যেমন যৌনকর্মী, সমকামী পুরুষ, এবং ট্রাক চালকদের মধ্যে এই সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।
৩. সংক্রমিত রক্ত ও রক্তজাত পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে
ত্রিপুরায় সংক্রমিত রক্ত ও রক্তজাত পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে এইচআইভি সংক্রমণও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। যদিও এই ধরনের সংক্রমণ কম, তবে এটি সম্পূর্ণরূপে এড়ানো যায় না।
৪. মাতৃগর্ভে সংক্রমণ
মাতৃগর্ভে সংক্রমণও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ থাকলে সন্তান জন্মের সময় সংক্রমণ হতে পারে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
ত্রিপুরায় এইচআইভি সংক্রমণের হার বৃদ্ধির ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়ছে। বিশেষ করে যুবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাদের শিক্ষাজীবন ও ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে। অনেক পরিবারই এই সমস্যার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ
ত্রিপুরা সরকার ও TSACS বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে। এর মধ্যে রয়েছে:
- সচেতনতা প্রচার: সকল স্কুলে প্রতি সপ্তাহে একটি বিশেষ সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এইচআইভি/এইডস ও মাদকাসক্তি সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে।
- মেডিকেল সাপোর্ট: এন্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি (ART) কেন্দ্রগুলিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে ত্রিপুরায় ১৫৪টি কেন্দ্র রয়েছে যেখানে এইচআইভি পরীক্ষা ও কাউন্সেলিং করা হয়।
- মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র: রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
ত্রিপুরায় এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবন, যৌন সংস্পর্শ, সংক্রমিত রক্ত ও রক্তজাত পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে এই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি, এবং মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ত্রিপুরার যুবক ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় এই পদক্ষেপগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।