ট্রাম্পের শুল্ক ঘূর্ণি অব্যাহত: ভারতীয় রফতানিতে ৫০% শুল্কের পর এবার ২০০% ‘ট্যারিফ বোমার’ হুমকি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ আরও উত্তপ্ত হয়েছে। ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর এবার দেশটির ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ২০০ শতাংশ 'ট্যারিফ বোমা' হানার প্রস্তুতিতে রয়েছে আমেরিকা। একই সঙ্গে…

Avatar

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ আরও উত্তপ্ত হয়েছে। ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর এবার দেশটির ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ২০০ শতাংশ ‘ট্যারিফ বোমা’ হানার প্রস্তুতিতে রয়েছে আমেরিকা। একই সঙ্গে ভারত-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ককে ‘একতরফা বিপর্যয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে ভারত এই শুল্ক আরোপকে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

গত ২৭ আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক বলবৎ হওয়ার পর এখন দেশটির বিরুদ্ধে আরও কঠিন পদক্ষেপের হুমকি ঝুলছে। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ ট্রুথ সোশালে নতুন পোস্টে ট্রাম্প বলেছেন, ভারত এখন মার্কিন পণ্যে শুল্ক শূন্যে নামানোর প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তিনি মন্তব্য করেন, “তারা এটা বহু বছর আগেই করতে পারত।”

ট্রাম্প আরও দাবি করেন, দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক পুরোপুরি একপাক্ষিক। তার ভাষায়, “খুব কম মানুষই বোঝেন যে আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করি, কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে প্রচুর ব্যবসা করে। তারা আমাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক, কিন্তু আমরা তাদের খুব কম বিক্রি করি।”

মার্কিন প্রশাসনের প্রাথমিক শুল্ক আরোপের কারণ হিসেবে ভারতের রুশ তেল আমদানিকে দায়ী করা হয়েছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাশিয়ার তেল আমদানির কারণেই ভারতের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রথমে ২৫ শতাংশ প্রতিক্রিয়াশীল শুল্ক এবং তার সঙ্গে রুশ তেল কেনার জন্য অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ জরিমানা মিলিয়ে মোট ৫০ শতাংশ হয়েছে।

বর্তমানে ভারত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকৃত টেক্সটাইল ও পোশাক, রত্ন ও গহনা, সামুদ্রিক খাদ্য (বিশেষত চিংড়ি), এবং চামড়াজাত দ্রব্যের ওপর এই শুল্ক প্রযোজ্য। তবে ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প এবং ইলেকট্রনিক্স ও স্মার্টফোন (অ্যাপল আইফোনসহ) এই শুল্কের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল।

কিন্তু এখন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসন ফার্মাসিউটিক্যালস খাতেও ২০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে। যদিও এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। দশকের পর দশক ধরে আমেরিকা বিদেশি ওষুধে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি দিয়ে এসেছে।

আমেরিকায় জেনেরিক ওষুধের একটি বিশাল অংশ ভারত থেকে আসে। ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলে তা আমেরিকার ওষুধের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করবে এবং সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এমনকি ২৫ শতাংশ শুল্কও ওষুধের মজুদে ১০ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতি আনতে পারে।

বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের মোট পণ্য বাণিজ্য ছিল প্রায় ১২৮.৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ভারত থেকে আমেরিকায় রফতানি ছিল ৮৭.৩ বিলিয়ন ডলার এবং আমেরিকা থেকে ভারতে রফতানি ৪১.৫ বিলিয়ন ডলার। পণ্য বাণিজ্যে ভারতের পক্ষে ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত রয়েছে।

তবে সেবা খাতের হিসাব অন্তর্ভুক্ত করলে চিত্রটি ভিন্ন হয়ে আসে। ২০২ৄ সালে দুই দেশের মধ্যে মোট পণ্য ও সেবা বাণিজ্য ছিল ২১২.৩ বিলিয়ন ডলার। সেবা খাতে আমেরিকার পক্ষে ১০২ মিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সব মিলিয়ে আমেরিকার আয় বিবেচনায় নিলে দেশটির পক্ষে ৩৫-৪০ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়াল জানিয়েছেন, আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। মার্চ থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। তবে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর নির্ধারিত ষষ্ঠ দফার আলোচনা স্থগিত করেছে মার্কিন দল।

চীনের তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সামিটের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পার্শ্ববৈঠকের পরপরই ট্রাম্পের সর্বশেষ মন্তব্য এসেছে। এই বৈঠকে তিন দেশের নেতারা আমেরিকার একচেটিয়া ও আধিপত্যবাদী নীতির বিপরীতে একটি বহুমেরু বিশ্ব গড়ার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই কঠোর অবস্থানের পেছনে রয়েছে ভারতকে রাশিয়া থেকে দূরে রাখার কৌশল। হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পিটার নাভারো স্পষ্টভাবেই বলেছেন, “ইউক্রেনে শান্তির রাস্তা দিল্লি দিয়েই যায়।” এর মানে হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতকে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপে রাখতেই এই পদক্ষেপ।

তবে ভারত সরকার এসব শুল্কের তীব্র সমালোচনা করে জানিয়েছে, এগুলো ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মের বিপরীত’। ভারত তুলে ধরেছে, আমেরিকা ও ইউরোপ নিজেরাই রুশ সার ও রাসায়নিক দ্রব্য কিনে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ভারত কৃষক ও দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের স্বার্থের সঙ্গে কখনো আপস করবে না। তিনি বলেছেন, “আমি জানি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মূল্য দিতে হতে পারে, কিন্তু আমি প্রস্তুত।”

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভারত সরকার কিছু পাল্টা ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক মওকুফ এবং রফতানি বাজার বৈচিত্র্যকরণের জন্য বাণিজ্য আলোচনা ত্বরান্বিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে সাধারণ কারখানার শ্রমিকদের জন্য এসব ব্যবস্থার তাৎক্ষণিক প্রভাব সামান্যই হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই শুল্ক যুদ্ধ দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে গভীর ক্ষত রেখে যেতে পারে। একসময়ের কৌশলগত অংশীদার আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে এই বাণিজ্যিক টানাপোড়েন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক এবং আমেরিকার কঠোর অবস্থানের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন স্বল্পমেয়াদি এবং শীঘ্রই তা সমাধান হবে। তবে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, দ্রুত কোনো সমাধানের আশা কম।

শুল্ক আরোপের প্রভাব ইতোমধ্যে ভারতীয় রফতানিকারকদের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। টেক্সটাইল, গহনা, সামুদ্রিক খাদ্য এবং চামড়াজাত পণ্যের রফতানিকারকরা বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছেন। অনেকে রাশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন অংশ এবং দক্ষিণ আমেরিকার দিকে নজর দিচ্ছেন।

তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ২০০ শতাংশ ফার্মা শুল্কের হুমকি নিয়ে। ভারত বিশ্বের জেনেরিক ওষুধের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী। আমেরিকায় ব্যবহৃত অনেক প্রয়োজনীয় ওষুধ ভারত থেকে আসে। এই খাতে শুল্ক আরোপিত হলে তা কেবল দুই দেশের বাণিজ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, আমেরিকার সাধারণ মানুষের চিকিৎসা খরচও বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একদিকে ভারত তার জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে দৃঢ়প্রত্যয়ী, অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন কঠোর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ভারতকে নিজেদের শর্তে বাণিজ্য করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। এই দ্বন্দ্ব দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

About Author
Avatar

আন্তর্জাতিক খবরের সর্বশেষ আপডেট, গভীর বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ঘটনাবলীর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে আমাদের International Desk-এ আসুন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, রাজনৈতিক গতিবিধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে এই পাতাটি আপনার একমাত্র গন্তব্য।