আদালতের রায়ে হোঁচট ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি, জাপানের সঙ্গে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি এখন গভীর সংকটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্ক নীতিতে বড় আইনি বিপর্যয় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আপিল আদালত তার বেশিরভাগ শুল্ক নীতিকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। একই সময়ে জাপান তার সাথে ৫৫০ বিলিয়ন…

Avatar

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্ক নীতিতে বড় আইনি বিপর্যয় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আপিল আদালত তার বেশিরভাগ শুল্ক নীতিকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। একই সময়ে জাপান তার সাথে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তির আলোচনা স্থগিত করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোণঠাসা।

গত শুক্রবার ওয়াশিংটনের ফেডারেল সার্কিট কোর্টের ১১ জন বিচারকের মধ্যে ৭-৪ ভোটে এই রায় আসে। আদালত রায়ে বলেছে, ট্রাম্প তার জরুরি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী শুল্ক আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (আইইইপিএ) তাকে এ ধরনের শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেয় না। তবে আদালত তার রায় অক্টোবর ১৪ পর্যন্ত স্থগিত রেখেছে, যাতে ট্রাম্প প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারে।

রায়ের পর ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “সব শুল্ক এখনও বহাল আছে! আজকে একটি অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট আপিল আদালত ভুলভাবে বলেছে যে আমাদের শুল্ক সরানো উচিত, কিন্তু তারা জানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত জিতবে।” তিনি আরও বলেছেন, “এই শুল্কগুলো যদি কখনো চলে যায়, তাহলে এটা দেশের জন্য সম্পূর্ণ বিপর্যয় হবে।”

এদিকে জাপানের সাথে ট্রাম্পের বাণিজ্য আলোচনায়ও মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে। জাপানের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী রিয়োসেই আকাজাওয়া গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন সফর আকস্মিকভাবে বাতিল করেছেন। এই সফরে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্যাকেজ নিয়ে লিখিত চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। জাপানের সরকারি মুখপাত্র ইয়োশিমাসা হায়াশি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “প্রশাসনিক পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজনীয় বিষয়াদি রয়েছে বলে এই সফর স্থগিত করা হয়েছে।”

জুলাই মাসে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তিতে পৌঁছেছিল যেখানে জাপানি পণ্যের ওপর শুল্ক ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিনিময়ে জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। জাপানি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে মার্কিন প্রশাসন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অতিরিক্ত শুল্ক ফেরত দিচ্ছে না।

ভারতের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আরও কঠোর রূপ নিয়েছে। রুশ তেল কেনার জন্য তিনি ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ শুল্কহারের মধ্যে অন্যতম। এই শুল্ক আগস্টের ২৭ তারিখ থেকে কার্যকর হয়েছে। ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পোশাক, মূল্যবান পাথর ও অলংকার, জুতা, ক্রীড়া সামগ্রী, আসবাবপত্র এবং রাসায়নিক দ্রব্যের ওপর এই শুল্ক প্রযোজ্য।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি করছে। প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, “ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ ভারতকে চীনের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে।” তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এই নীতি দশকের পর দশক ধরে গড়ে তোলা মার্কিন-ভারত কৌশলগত সম্পর্ক নষ্ট করছে।

আদালতের রায়ের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প ১৯৭৭ সালের আইইইপিএ আইনের অপব্যবহার করেছেন। এই আইনটি মূলত জাতীয় জরুরি অবস্থায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ ক্রোক আটকানোর জন্য তৈরি হয়েছিল, শুল্ক আরোপের জন্য নয়। আদালত স্পষ্ট করে বলেছে, “কংগ্রেসের মৌলিক কতৃর্ত্ব হলো কর ও শুল্ক আরোপ করা, এটি শুধুমাত্র আইনসভার এক্তিয়ার।”

ট্রাম্প এপ্রিলের ২ তারিখকে “মুক্তি দিবস” ঘোষণা করে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি আছে এমন দেশগুলোর ওপর তিনি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত “পরস্পরিক শুল্ক” এবং অন্যান্য দেশের ওপর ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক আরোপ করেন। এই শুল্ক থেকে তার প্রশাসন প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের আশা করছিল।

তবে আদালতের এই রায়ে ভারতের ওপর আরোপিত শুল্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রাথমিক শুল্ক আরোপের পর ট্রাম্প আইনি চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করে পরবর্তী দফায় অন্যান্য আইনও ব্যবহার করেছেন। এর ফলে ভারতের ওপর আরোপিত সব শুল্ক বাতিল নাও হতে পারে।

মার্কিন বিভিন্ন রাজ্য ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে অন্তত আটটি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ছোট আমেরিকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ১২টি গণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বাধীন রাজ্যের যৌথ মামলা রয়েছে। তারা যুক্তি দিয়েছে যে আইইইপিএ আইন শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেয় না এবং সংবিধান অনুযায়ী এই ক্ষমতা কেবল কংগ্রেসের।

জাপানের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল। জুলাইয়ের চুক্তি অনুযায়ী জাপানি গাড়ি ও যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক ২৭.৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। জাপানি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে অন্যান্য পণ্যের ওপর “শুল্ক স্তুপীকরণ” হচ্ছে, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ শুল্কের ওপর আরও শুল্ক যুক্ত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিজনেস স্কুলের অর্থনীতিবিদ ড. লিন্ডা ইউয়েহ বিবিসিকে বলেছেন, “বিশ্বের নানা দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঝুঁকি কমানোর কথা ভাবছে।” তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই অনিশ্চয়তা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যক্রম মন্থর করে দিতে পারে।

ভারতের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রভাব ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশটির রপ্তানি খাতে, বিশেষ করে শ্রমনিবিড় শিল্পগুলোতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। বস্ত্র, পাদুকা, অলংকার ও চিংড়ি রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছেন। ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে সাশ্রয়ী তেল কিনে ১৭ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করলেও ট্রাম্পের শুল্কের কারণে ৩৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে এগিয়েছে। দুই দেশ ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকার সংঘাতের পর প্রথমবারের মতো সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি সাত বছর পর প্রথমবারের মতো চীন সফরের পরিকল্পনা করেছেন।

মার্কিন হাউজ পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্যরা ট্রাম্পের ভারত নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, রুশ তেল কেনার জন্য শুধু ভারতকে লক্ষ্য করা হচ্ছে, অথচ চীনসহ অন্যান্য দেশ আরও বেশি রুশ তেল কিনছে। কমিটি একটি বিবৃতিতে বলেছে, “ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকানদের ক্ষতি করছে এবং মার্কিন-ভারত সম্পর্ক নষ্ট করছে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মামলাটি অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছাবে। যদি সুপ্রিম কোর্ট আপিল আদালতের রায় বহাল রাখে, তাহলে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং আমদানিকারকরা ইতিমধ্যে দেওয়া শুল্ক ফেরত চাইতে পারবেন।

হোয়াইট হাউসের উপ-সংবাদ সচিব কুশ দেশাই বলেছেন, “শুল্কগুলো এখনও বহাল আছে এবং আমরা এই বিষয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।” ট্রাম্প প্রশাসন আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করছে যে সুপ্রিম কোর্ট তাদের পক্ষে রায় দেবে, কারণ আগে অন্যান্য বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের পক্ষেই রায় দিয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আইনি লড়াই ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করতে পারে। আদালতের রায়ের ফলে তার আলোচনার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং অন্যান্য দেশগুলো এখন তার দাবি অগ্রাহ্য করতে পারে। বিশেষ করে জাপানের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশও এখন শুল্ক নিয়ে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।

About Author
Avatar

আন্তর্জাতিক খবরের সর্বশেষ আপডেট, গভীর বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ঘটনাবলীর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে আমাদের International Desk-এ আসুন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, রাজনৈতিক গতিবিধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে এই পাতাটি আপনার একমাত্র গন্তব্য।