এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাপানি গাড়ির ওপর থেকে শুল্ক কমানোর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে জাপানে তৈরি গাড়ির ওপর মার্কিন শুল্কের হার ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে আসবে। এই পদক্ষেপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাক্ষরিত এক বৃহত্তর বাণিজ্য চুক্তির বাস্তবায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই নতুন আদেশের ফলে জাপানের অটোমোবাইল শিল্প, বিশেষ করে টয়োটা, হোন্ডা, এবং নিসানের মতো সংস্থাগুলি মার্কিন বাজারে বড় ধরনের স্বস্তি পাবে। দীর্ঘদিন ধরেই এই সংস্থাগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত সেই বাধা দূর করে তাদের জন্য নতুন সুযোগের দরজা খুলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাণিজ্য চুক্তির নেপথ্যে
এই শুল্ক হ্রাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে একটি ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তির অংশ। এই চুক্তির আওতায়, জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ মার্কিন পরিকাঠামো, প্রযুক্তি এবং উৎপাদন খাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর বিনিময়েই মার্কিন প্রশাসন জাপানি গাড়ির ওপর থেকে শুল্ক কমাতে সম্মত হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই চুক্তিটি উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। জাপানের এই বিপুল বিনিয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং আমাদের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে। বিনিময়ে, আমরা জাপানের অটোমোবাইল শিল্পের জন্য আমাদের বাজার আরও উন্মুক্ত করছি।”
শুল্ক হ্রাসের প্রভাব
বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য কিছু গাণিতিক হিসাব দেখা যাক। আগে যেখানে একটি ৩০,০০০ ডলার মূল্যের জাপানি গাড়ির ওপর ২৭.৫% হারে ৮,২৫০ ডলার শুল্ক দিতে হতো, নতুন নিয়মে ১৫% হারে সেই শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪,৫০০ ডলার। অর্থাৎ, প্রতিটি গাড়ির ওপর শুল্ক বাবদ খরচ কমবে ৩,৭৫০ ডলার।
- পূর্বের শুল্ক হার: ২৭.৫%
- নতুন শুল্ক হার: ১৫%
- শুল্ক হ্রাস: ১২.৫ শতাংশ পয়েন্ট
- উদাহরণ: একটি ৩০,০০০ ডলারের গাড়িতে শুল্ক সাশ্রয়: $30,000 * (27.5% – 15%) = $3,750
এই বিপুল পরিমাণ সাশ্রয়ের ফলে জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি হয় তাদের গাড়ির দাম কমিয়ে মার্কিন ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারবে, অথবা অতিরিক্ত মুনাফা গবেষণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে তাদের পণ্যের মান আরও উন্নত করতে পারবে। উভয় ক্ষেত্রেই, তারা মার্কিন বাজারে তাদের প্রতিযোগীদের, বিশেষ করে ইউরোপীয় এবং দক্ষিণ কোরীয় গাড়ি নির্মাতাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে।
শুধু গাড়ি নয়, কৃষিক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনা
এই বাণিজ্য চুক্তির প্রভাব শুধু অটোমোবাইল শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। চুক্তির অংশ হিসেবে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষি পণ্য আমদানি বাড়াতেও সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ভুট্টা, এবং সয়াবিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শস্য। জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চালের আমদানি ৭৫% বৃদ্ধি করার এবং বার্ষিক ৮ বিলিয়ন ডলারের কৃষি পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি মার্কিন কৃষকদের জন্য এক বিরাট সুখবর, যারা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের পণ্যের জন্য নতুন বাজারের সন্ধান করছিল।
বিশ্ব বাণিজ্যে এর প্রভাব
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ বিশ্ব বাণিজ্যে এক নতুন সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। একসময় যে ট্রাম্প প্রশাসন সংরক্ষণশীল বাণিজ্য নীতির জন্য পরিচিত ছিল, তারাই এখন জাপানের মতো দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের মিত্র জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার দিকে ঝুঁকছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলি কিছুটা চাপের মুখে পড়বে। কারণ, তাদের তৈরি গাড়িগুলিকে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের মুখেই পড়তে হচ্ছে। হুন্ডাই এবং কিয়ার মতো সংস্থাগুলিকে জাপানি সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
শেষ কথা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একদিকে যেমন এটি জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তেমনই অন্যদিকে এটি বিশ্ব বাজারে নতুন প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে। আগামী দিনে এই চুক্তির সম্পূর্ণ প্রভাব স্পষ্ট হবে, তবে আপাতত জাপানের অটোমোবাইল শিল্প যে এক বড় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন ক্রেতারাও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তাদের পছন্দের জাপানি গাড়িগুলি আরও সুলভ মূল্যে কেনার সুযোগ পাবেন।