প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৭৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এই ফোন কলটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে কারণ গত কয়েক মাস ধরে ভারতের রাশিয়ান তেল কেনাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দিয়েছিল। ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “আমার বন্ধু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে একটি চমৎকার ফোন আলাপ হলো। আমি তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছি! তিনি দুর্দান্ত কাজ করছেন। নরেন্দ্র: রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করতে আপনার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ!”।
মোদী এক্স প্ল্যাটফর্মে জবাবে ট্রাম্পকে “আমার বন্ধু” বলে সম্বোধন করে লিখেছেন, “আমার বন্ধু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আমার ৭৫তম জন্মদিনে আপনার ফোন কল এবং উষ্ণ শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। আপনার মতোই, আমিও ভারত-মার্কিন ব্যাপক এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আপনার উদ্যোগকে সমর্থন করি”।
এই ফোন আলাপ ছিল জুন ১৭ তারিখের পর দুই নেতার মধ্যে প্রথম কথোপকথন। রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রাম্প গত কয়েক মাস ধরে মোদীকে একাধিক বার ফোন করেছিলেন, কিন্তু মোদী সেই কলগুলো এড়িয়ে গিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউস এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছিল, তবে ট্রাম্পের এই দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত কথোপকথনের ঘোষণায় তার উৎসাহ স্পষ্ট ছিল।
ট্রাম্প-মোদী কথোপকথনের পেছনে রয়েছে একটি জটিল কূটনৈতিক পরিস্থিতি। গত মাসে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন, যার মধ্যে ২৫ শতাংশ ছিল ভারতের রাশিয়ান তেল ক্রয়ের জন্য শাস্তিস্বরূপ। ট্রাম্প প্রশাসন অভিযোগ করেছে যে, ভারত রাশিয়ান তেল কিনে পরোক্ষভাবে ইউক্রেনের যুদ্ধে মস্কোর যুদ্ধ তহবিল জোগান দিচ্ছে।
কিন্তু মঙ্গলবারের ফোন আলাপে ট্রাম্প কোনো সমালোচনা করেননি, বরং মোদীর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই পরিবর্তনটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় কারণ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই ট্রাম্প ভারতের সাথে আমেরিকার “একতরফা বিপর্যয়কর” সম্পর্কের কথা বলে ট্রুথ সোশ্যালে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
বাণিজ্য আলোচনার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে এই ফোন আলাপের ঠিক কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডান লিঞ্চের নেতৃত্বে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব রাজেশ আগ্রওয়ালের সাথে বৈঠক করেছে। দুই পক্ষই এই আলোচনাকে “ইতিবাচক” ও “ভবিষ্যৎমুখী” বলে অভিহিত করেছে এবং পারস্পরিক উপকারী বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পন্নের জন্য প্রচেষ্টা তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের স্থায়ী গুরুত্ব স্বীকার করে, আলোচনাগুলো ইতিবাচক এবং ভবিষ্যৎমুখী ছিল, যা বাণিজ্য চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছে। পারস্পরিক উপকারী বাণিজ্য চুক্তির দ্রুত সমাপ্তির জন্য প্রচেষ্টা তীব্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে”।
এই বাণিজ্য আলোচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ গত মাসে আগস্টে পরিকল্পিত একটি মার্কিন প্রতিনিধি দলের নয়াদিল্লি সফর বাতিল হয়ে গিয়েছিল যখন আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছেছিল। ভারত আমেরিকার দাবি মেনে তার বিস্তৃত কৃষি ও দুগ্ধ বাজার খুলে দিতে অস্বীকার করেছিল। অন্যদিকে আমেরিকা চেয়েছিল ভারত রাশিয়ান তেল কেনা বন্ধ করুক।
শুল্কের প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে আমেরিকায় ভারতের রপ্তানি ছিল ৮.০১ বিলিয়ন ডলার, যা আগস্টে কমে ৬.৮৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। রপ্তানিকারকরা সতর্ক করেছেন যে, নতুন শুল্কের পূর্ণ প্রভাব সেপ্টেম্বর থেকে অনুভূত হবে।
ট্রাম্প ও মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দুই নেতার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। “হাওডি মোদী” এবং “নমস্তে ট্রাম্প” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুই নেতা তাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। ট্রাম্প একাধিকবার মোদীকে “দুর্দান্ত নেতা” ও চমৎকার দর কষাকষির দক্ষতার অধিকারী বলে প্রশংসা করেছেন।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন ১৭ তারিখে দুই নেতার মধ্যে ৩৫ মিনিটের একটি কঠিন ফোন আলাপ হয়েছিল, যা সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেই আলাপে মোদী ট্রাম্পকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, ভারত কখনো মধ্যস্থতা মেনে নেবে না, বিশেষ করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গটি দুই নেতার কথোপকথনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ট্রাম্প মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে তার সহায়তার জন্য। অন্যদিকে মোদী ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ট্রাম্পের উদ্যোগকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। এই বিনিময় দেখায় যে, দুই নেতা ইউক্রেন সংকট সমাধানে একসাথে কাজ করতে আগ্রহী।
মোদীর জন্মদিন উপলক্ষে ভারতজুড়ে বিশেষ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সেপ্টেম্বর ১৭ থেকে অক্টোবর ২ পর্যন্ত “সেবা পক্ষ” পালন করছে। এই দুই সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিতে রক্তদান শিবির, পরিচ্ছন্নতা অভিযান এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
মোদী ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গুজরাতের বাদনগর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণকারী প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং কংগ্রেস পার্টির বাইরে দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা নেতা। তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক রেকর্ড রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ এবং একটানা দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন।
আন্তর্জাতিক নেতাদের কাছ থেকেও মোদীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা এসেছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মোদীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী পর্যন্ত সকলেই মোদীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
এই ফোন কলটি ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যদিও বাণিজ্যিক বিরোধ এবং রাশিয়ান তেল ইস্যু এখনো অমীমাংসিত রয়েছে, তবুও দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং ইউক্রেন সমস্যায় সহযোগিতার ইচ্ছা ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কথোপকথন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হতে পারে।