ট্রাম্পের চারবার ফোনে অপেক্ষা, মোদীর নীরবতা: জার্মান গণমাধ্যমের চাঞ্চল্যকর দাবি

জার্মানির প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফ্রাঙ্কফুর্টার আলগেমাইনে সাইতুং (এফএজেড) একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত চারবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন,…

Avatar

 

জার্মানির প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফ্রাঙ্কফুর্টার আলগেমাইনে সাইতুং (এফএজেড) একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদনে দাবি করেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত চারবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রতিবারই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার ফোন ধরতে অস্বীকার করেছেন। এই অভূতপূর্ব ঘটনা ভারত-মার্কিন সম্পর্কের বর্তমান সংকটের গভীরতা তুলে ধরে এবং দুই বৈশ্বিক নেতার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রতিফলন ঘটায়।

এফএজেড-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে মোদীর এই ফোন না তোলার ঘটনা তার “গভীর ক্ষোভ এবং সতর্কতার” পরিচায়ক। জার্মান সংবাদমাধ্যমটি আরও উল্লেখ করে যে, ট্রাম্পের প্রচলিত কৌশল – অভিযোগ, হুমকি এবং চাপ প্রয়োগ – যা অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছিল, ভারতের ক্ষেত্রে সেটি ব্যর্থ হচ্ছে।

গত ২৭ আগস্ট থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ভারতের রপ্তানিকারকদের জন্য এক বিরাট আঘাত। এই শুল্কের অর্ধেক ভারতের রাশিয়ান তেল ক্রয়ের বিপরীতে শাস্তিমূলক এবং বাকি অর্ধেক বাণিজ্য বৈষম্যের কারণে আরোপিত হয়েছে।

ট্রাম্প সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতকে “মৃত অর্থনীতি” বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ বিষয়ে তার তিক্ত মন্তব্য করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানের সাথে তার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করেছেন, যা নয়াদিল্লিতে তীব্র বিরক্তির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনা ভারত সরকারে উস্কানিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছে।

এফএজেড-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারত চীনের দিকে ঝুঁকছে এবং পুরনো ক্ষত ভুলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, যেখানে ভারত চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করার কথা, সেটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গত মে মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে চার দিনের সামরিক সংঘাত হয়েছিল, তার বিষয়ে ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন যে তিনি যুদ্ধবিরতি আনতে মধ্যস্থতা করেছেন। কিন্তু ভারত সরকার এই দাবি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং স্পষ্ট করে দিয়েছে যে যুদ্ধবিরতি দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে হয়েছে, কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই।

পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র ১৮ জুন এক বিবৃতিতে বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদী ট্রাম্পকে “দ্ব্যর্থহীনভাবে” জানিয়ে দিয়েছেন যে ভারত কখনোই তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা গ্রহণ করে না এবং ভবিষ্যতেও করবে না। এই অবস্থান ভারতের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

জার্মান প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে মোদী ট্রাম্পের “ফাঁদে” পড়তে চান না। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে ট্রাম্প যেভাবে একটি ফোন কলের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় একতরফাভাবে বাণিজ্যিক চুক্তির কথা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, মোদী সেই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে চাইছেন। এই সতর্কতা ভারতের কূটনৈতিক পরিপক্বতার পরিচায়ক।

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের পূর্বাভাস অনুযায়ী, নতুন শুল্কের কারণে ভারতের রপ্তানি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যা ৬০.২ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৮.৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। এই পরিস্থিতিতে বস্ত্র, রত্ন ও অলংকার, চামড়াজাত পণ্য এবং সামুদ্রিক খাদ্যের মতো শ্রমনিবিড় খাতগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী গুজরাতে এক সভায় বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশকে “অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা” হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে “চাপ যতই বাড়ুক, ভারত তা সহ্য করার শক্তি অর্জন করতে থাকবে”।

বার্লিন-ভিত্তিক গ্লোবাল পাবলিক পলিসি ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক থরস্টেন বেনার সামাজিক মাধ্যম এক্সে এই জার্মান প্রতিবেদন শেয়ার করে লিখেছেন: “এফএজেড দাবি করেছে যে ট্রাম্প সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মোদীকে চারবার ফোন করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু মোদী তার কল প্রত্যাখ্যান করেছেন”।

এক সময়ের “হাউডি মোদী” এবং “নমস্তে ট্রাম্প” অনুষ্ঠানের উষ্ণ বন্ধুত্ব এখন শীতল হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে হিউস্টনে ৫০ হাজার লোকের সামনে দুই নেতার একসাথে হাঁটার সেই উজ্জ্বল মুহূর্তগুলো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যে ব্যক্তিগত সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, তা এখন রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতও ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপের শিকার হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে একসময় ট্রাম্পের ভালো দিকে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতেও জাপান মার্কিন সমালোচনা এড়াতে পারেনি।

ভারত সরকার প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ না করে বরং রপ্তানি প্রণোদনা মিশনের মাধ্যমে ক্ষতি কমানোর পথে হেঁটেছে। ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি রপ্তানি প্রণোদনা কর্মসূচি বিবেচনাধীন রয়েছে, যার মধ্যে বাণিজ্য অর্থায়ন, নিয়ন্ত্রক সহায়তা এবং “ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া”র উন্নত ব্র্যান্ডিং অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত চীন, ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মতো বিকল্প বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করছে। প্রায় ৫০টি দেশে বস্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়াজাত দ্রব্য এবং সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য সরকার পরিকল্পনা তৈরি করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং দুই বৈশ্বিক নেতার অহংবোধের সংঘাতও বটে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে “অহং এবং ভুল পদক্ষেপ” এই সম্পর্কে বিরক্তি বৃদ্ধি করেছে।

জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়াও অনুরূপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে মোদী ট্রাম্পের ফোন এড়িয়ে চলেছেন, যা “ট্রাম্পের হতাশা বৃদ্ধি করেছে”। তবে ভারত বা মার্কিন সরকার এই দাবিগুলো নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি।

অর্থনীতিবিদদের অনুমান অনুযায়ী, এই শুল্কের কারণে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী অর্থবছরে ০.৪-০.৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগ, শ্রমবাজার এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা ভারত-মার্কিন কৌশলগত অংশীদারিত্ব এখন একটি গুরুতর পরীক্ষার মুখে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান এবং ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তায় যে সহযোগিতা গড়ে উঠেছিল, তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে।

পূর্বতন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন মন্তব্য করেছেন যে ভারতও ট্রাম্পের আচরণে “গভীরভাবে ক্ষুব্ধ” বোধ করছে, কারণ ভারতই একমাত্র দেশ যার ওপর শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি এসেছে, অথচ রাশিয়া এবং চীন মূলত অস্পৃশ্য রয়ে গেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-মার্কিন বাণিজ্যিক আলোচনা স্থগিত রয়েছে। আমেরিকান আলোচকরা ২৫ আগস্ট ভারত সফরের জন্য নির্ধারিত তারিখ স্থগিত করেছেন। এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে যে ৫০০ বিলিয়ন ডলার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল, তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

About Author
Avatar

আন্তর্জাতিক খবরের সর্বশেষ আপডেট, গভীর বিশ্লেষণ এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ঘটনাবলীর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেতে আমাদের International Desk-এ আসুন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ, রাজনৈতিক গতিবিধি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে এই পাতাটি আপনার একমাত্র গন্তব্য।