মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান বাডি কার্টার এই মনোনয়ন প্রদান করেছেন, যা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘ ১২ দিনের তীব্র সংঘাতের পর এই যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
ট্রাম্পের নোবেল মনোনয়নের পেছনের কাহিনী
জর্জিয়ার প্রতিনিধি বাডি কার্টার গত ২৪ জুন ২০২৫ তারিখে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির কাছে একটি পত্র পাঠিয়ে ট্রাম্পের নাম মনোনয়নের জন্য প্রস্তাব করেন। কার্টার তার পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রভাব একটি দ্রুত চুক্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যা অনেকেই অসম্ভব বলে মনে করতেন।”
এই মনোনয়নের বিশেষত্ব হলো যে, ট্রাম্প শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠাই করেননি, বরং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতেও সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। কার্টারের মতে, “বিশ্বের বৃহত্তম সন্ত্রাস পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে বিরত রাখতে ট্রাম্প বলিষ্ঠ ও সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।”
১২ দিনের যুদ্ধের বিস্তারিত চিত্র
সংঘাতের সূচনা
গত ১২ জুন ২০২৫ তারিখে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে এই সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়। ইসরায়েলি বাহিনী দাবি করে যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অত্যন্ত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি ছিল। এই আক্রমণের মধ্যে ছিল নাতানজ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র এবং ইসফাহান পারমাণবিক কমপ্লেক্সের ওপর হামলা।
ইরানের প্রতিশোধমূলক আক্রমণ
ইসরায়েলি আক্রমণের জবাবে ইরান “অপারেশন ট্রু প্রমিস III” নামে একটি ব্যাপক প্রতিশোধমূলক অভিযান চালায়। এই অভিযানে ইরান ৫০০ থেকে ৫৫০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১০০০টিরও বেশি ড্রোন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করে। তবে ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই আক্রমণের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সফলভাবে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ
পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক কেন্দ্রে সরাসরি বিমান হামলা চালায়। ফোরদো, নাতানজ এবং ইসফাহানের এই স্থাপনাগুলো ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী “সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস” হয়ে যায়। এই আক্রমণ আমেরিকার দীর্ঘদিনের নীতির একটি বড় পরিবর্তন ছিল, কারণ এর আগে আমেরিকা কখনো ইরানের ভূখণ্ডে সরাসরি সামরিক অভিযান চালায়নি।
যুদ্ধবিরতির জটিল প্রক্রিয়া
যুদ্ধবিরতি ঘোষণা
২৩ জুন ২০২৫ তারিখে ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে “সম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি” ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধবিরতির কাঠামো ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট – প্রথমে ইরান মধ্যরাত থেকে তাদের আক্রমণ বন্ধ করবে, এবং ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েল তাদের অভিযান স্থগিত করবে। এই ২৪ ঘণ্টা পর যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
কাতারের মধ্যস্থতা
এই যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় কাতার গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। কাতারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছাড়া এই জটিল পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। আল উদাইদ এয়ারবেসে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের পরও কাতার তাদের মধ্যস্থতার ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ
পারস্পরিক অভিযোগ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। ইসরায়েল দাবি করে যে, ইরান যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যার ফলে বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। অন্যদিকে, ইরান এই অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলার দাবি করে।
ট্রাম্পের হতাশা প্রকাশ
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প তার হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, “আমাদের এমন দুটি দেশ আছে যারা এত দীর্ঘ সময় ধরে এত কঠিন যুদ্ধ করেছে যে তারা নিজেরাই জানে না তারা কী করছে।” তিনি বিশেষভাবে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি পরবর্তী আক্রমণের সমালোচনা করেছেন এবং আরো আক্রমণ না করার জন্য সতর্ক করেছেন।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও বিশ্লেষণ
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন
এই ১২ দিনের সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে বড় পরিবর্তন এনেছে। ইসরায়েল প্রথমবারের মতো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় সরাসরি আক্রমণের সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, যা তাদের সামরিক শক্তির একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অন্যদিকে, আমেরিকার সরাসরি হস্তক্ষেপ ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, প্রয়োজনে আমেরিকা তাদের ভূখণ্ডেও অভিযান চালাতে পারে।
পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে এই আক্রমণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে তা এখনো অস্পষ্ট। যদিও ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, প্রধান স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, তবে ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তি ও জ্ঞান এখনো অক্ষত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ইরান তাদের কর্মসূচি পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে নাকি আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে, সেটাই এখন প্রধান প্রশ্ন।
যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ
ভঙ্গুর শান্তি
বিশেষজ্ঞরা এই যুদ্ধবিরতিকে অত্যন্ত ভঙ্গুর বলে মনে করছেন। মাত্র ২৪ ঘণ্টার একটি প্রাথমিক চুক্তি দীর্ঘমেয়াদী শান্তির জন্য যথেষ্ট নয়। উভয় পক্ষের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস এবং পারস্পরিক শত্রুতার ইতিহাস এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্বের জন্য বড় হুমকি।
আঞ্চলিক প্রক্সি দ্বন্দ্ব
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ থেমে গেলেও, এই অঞ্চলে তাদের প্রক্সি বাহিনীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। হিজবুল্লাহ, হামাস এবং অন্যান্য ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো এই যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।
নোবেল পুরস্কারের সম্ভাবনা ও বিতর্ক
পূর্ববর্তী মনোনয়ন
এটি ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রথম মনোনয়ন নয়। এর আগেও তিনি একাধিকবার এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তবে কখনো জিততে পারেননি। এবারের মনোনয়নটি তার পূর্ববর্তী প্রচেষ্টার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি সক্রিয় সংঘাত নিরসনের সাথে জড়িত।
আন্তর্জাতিক মতামত
এই মনোনয়ন আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। সমর্থকরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ট্রাম্পের দৃঢ় কূটনীতি একটি বড় যুদ্ধ এড়াতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে, সমালোচকরা মনে করেন যে, সামরিক শক্তি ব্যবহার করে শান্তি প্রতিষ্ঠা নোবেল পুরস্কারের আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ থামানোর জন্য ট্রাম্পের এই নোবেল শান্তি পুরস্কার মনোনয়ন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, তবুও একটি বড় আঞ্চলিক সংঘাত এড়ানো নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্য। আগামী দিনগুলোতে এই যুদ্ধবিরতি কতটা টেকসই হয় এবং ট্রাম্প আসলেই নোবেল পুরস্কার পান কিনা, সেটাই এখন বিশ্বের প্রত্যাশার কেন্দরবিন্দু।