যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ, ২০২৫) একটি ঐতিহাসিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যার মাধ্যমে দেশটির শিক্ষা দফতর (ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন) বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই আদেশের ফলে ফেডারেল সরকার শিক্ষা খাতে আর আগের মতো অর্থ বরাদ্দ করবে না। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই পদক্ষেপ পুরোপুরি কার্যকর করতে কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন, যা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে গেলে দেখা যায়, ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষা দফতর বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বারবার বলেছেন, এই দফতর শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকর কিছু করছে না, বরং আমলাতন্ত্র বাড়িয়ে অর্থ নষ্ট করছে। বৃহস্পতিবার সকালে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এই আদেশে সই করেন। ট্রাম্প বলেন, “আমরা এমন একটি ব্যবস্থা থেকে বাচ্চাদের মুক্তি দিতে চাই, যেটা তাদের জন্য কাজ করছে না।” তিনি আরও জানান, শিক্ষা দফতরের মূল কিছু কার্যক্রম, যেমন পেল গ্রান্ট বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য তহবিল, অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে চালিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু বাকি কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে যত দ্রুত সম্ভব।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে ট্রাম্পের যুক্তি বোঝার জন্য আরেকটু গভীরে যাওয়া দরকার। তিনি দাবি করেছেন, ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা দফতরে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের গণিত, বিজ্ঞান ও পড়ার দক্ষতা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটও এই দাবির সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, “এই দফতর শুধু টাকা নষ্ট করেছে, কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শিক্ষার দায়িত্ব রাজ্যগুলোর হাতে দিতে চান, যাতে স্থানীয় পর্যায়ে ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।” ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ এখন থেকে রাজ্য সরকারগুলোর ওপর নির্ভর করবে।
বিষয়টির গুরুত্ব বোঝার জন্য কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা দফতর বর্তমানে প্রায় ৪৪০০ কর্মচারী নিয়ে কাজ করে এবং এর বার্ষিক বাজেট প্রায় ৬৮ বিলিয়ন ডলার। এই দফতর স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক সহায়তা দেয়, শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করে এবং শিক্ষার্থীদের ঋণের ব্যবস্থা করে। ট্রাম্পের আদেশে এই দফতর বন্ধ হলে এসব কার্যক্রম অন্য কোনো সংস্থায় স্থানান্তরিত হবে কি না, তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকম্যাহন জানিয়েছেন, নিম্নআয়ের এলাকার স্কুলগুলোর জন্য ফেডারেল সাহায্য অব্যাহত থাকবে। এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অনেকে আশঙ্কা করছেন, শিক্ষায় বৈষম্য আরও বাড়তে পারে।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনাও কম হচ্ছে না। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, শিক্ষা দফতর বন্ধ করা শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাদের মতে, ফেডারেল সরকারের তত্ত্বাবধান ছাড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে শিক্ষার মানে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হবে। একজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর বলেন, “ধনী রাজ্যগুলো হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু গরিব রাজ্যগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।” এছাড়া শিক্ষক ইউনিয়নগুলোও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করেন, এতে শিক্ষকদের চাকরি ও স্কুলের তহবিল কমে যাবে।
অন্যদিকে, ট্রাম্পের সমর্থকরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, ফেডারেল সরকার শিক্ষায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করে, যা স্থানীয় চাহিদার সঙ্গে মানানসই নয়। একজন সমর্থক বলেন, “রাজ্যগুলো নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিজেরা ঠিক করতে পারবে, ওয়াশিংটনের আমলাদের দরকার নেই।” ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, “শিক্ষকরা আমাদের দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, আমরা তাদের দেখভাল করব।” তবে এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এই আদেশ কার্যকর করতে কংগ্রেসের সম্মতি লাগবে, যা সহজ হবে না। রিপাবলিকানদের হাউসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের প্রভাব রয়েছে। ফলে এই প্রস্তাব পাস করতে ট্রাম্পকে বড় ধরনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রক্রিয়া কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরও লাগতে পারে। ততদিন পর্যন্ত শিক্ষা দফতরের কার্যক্রম আংশিকভাবে চলতে থাকবে, তবে ট্রাম্পের প্রশাসন এটিকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলতে পারে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে। এটি সফল হলে রাজ্যভিত্তিক শিক্ষা নীতি শক্তিশালী হবে, কিন্তু ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। সবার চোখ এখন কংগ্রেসের দিকে, যারা এই আদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।