তুরস্ক-পাকিস্তান সামরিক জোট: ভারতের সীমান্তে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নয়া দিল্লি

সম্প্রতি পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারতের উপর তুরস্কের তৈরি ৩০০-৪০০টি ড্রোন হামলার ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে গভীর সামরিক সহযোগিতা প্রকাশ্যে এসেছে। ৮ মে রাতে লেহ থেকে সার স্ক্রিক পর্যন্ত ৩৬টি বিভিন্ন…

Avatar

 

সম্প্রতি পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারতের উপর তুরস্কের তৈরি ৩০০-৪০০টি ড্রোন হামলার ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে গভীর সামরিক সহযোগিতা প্রকাশ্যে এসেছে। ৮ মে রাতে লেহ থেকে সার স্ক্রিক পর্যন্ত ৩৬টি বিভিন্ন স্থানে এই অভূতপূর্ব ড্রোন অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে, যা ভারতীয় বাহিনী প্রতিহত করেছে। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রেসেপ তাইয়িপ এরদোগান পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’ কে “বেসামরিক নাগরিকদের শাহাদত” বলে অভিহিত করেছেন, যা দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মিত্রতার প্রমাণ দেয়।

তুরস্ক সম্প্রতি পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে (চীনের পরেই)। এই সামরিক জোটের শুরু ১৯৮৮ সাল থেকে মিলিটারি কনসাল্টেটিভ গ্রুপ ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে, কিন্তু সম্প্রতি তা উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার পর, যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ভারতের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিল, তুরস্ক তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সম্পদ পাঠিয়েছে।

রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ও ইসলামী বিশ্বে নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় দুই দেশের মধ্যে আদর্শিক সংযোগ গড়ে উঠেছে। ২০০৩ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক রাজনৈতিক ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে। এরদোগানের উম্মাহ (ইসলামী বিশ্ব) নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের ইসলামিক আদর্শিক ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ঐতিহাসিকভাবে, এই সম্পর্কের শিকড় শীতল যুদ্ধের সময়কালে যায়, যখন উভয় দেশই CENTO (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন) এবং RCD (রিজিওনাল কোঅপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট) এর অংশ ছিল। সাইপ্রাস সংকট (১৯৭৪) তাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে, যেখানে পাকিস্তান তুরস্কের পক্ষ সমর্থন করেছিল এবং ১৯৬৪ এবং ১৯৭১ সালের সংকটে সামরিক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্কের অবিরাম সমর্থন ভারত-তুরস্ক সম্পর্কের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি বিরক্তির কারণ হয়ে আছে। ২০১৩ সালে তৎকালীন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তুরস্কের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ভারতের ক্ষতির বিনিময়ে তোমার বন্ধুত্ব করো না’। ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ এরদোগান আবারও “কাশ্মীরি ভাইদের” প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন, যা ভারতের কাছ থেকে কূটনৈতিক প্রতিবাদ আহ্বান করেছে।

রক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে, পাকিস্তান তুরস্ক থেকে বায়রাকতার ড্রোন, কেমানকেস ক্রুজ মিসাইল এবং আসিসগার্ড সোনগার ড্রোন অধিগ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান তুরস্ক থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে ৩০টি টি১২৯ অ্যাটাক হেলিকপ্টার অর্ডার করেছে। একই বছর পাকিস্তান তুরস্কের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ঠিকাদার ASFAT-এর সাথে চারটি MILGEM-শ্রেণীর স্টেলথ করভেট জাহাজের জন্য একটি প্রধান চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

নৌবাহিনী আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে তুরস্ক পাকিস্তানের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১৮ সালে STM ডিফেন্স টেকনোলজিসের সাথে চারটি উন্নত করভেট জাহাজের জন্য ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এছাড়া তুরস্কের STM পাকিস্তানের আগোস্তা ৯০B সাবমেরিনগুলির মিড-লাইফ আপগ্রেড করছে, যেখানে আগে ফরাসি সংস্থা DCNS এই কাজ করত।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি আরও উদ্বেগজনক। পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলার পরে, যা জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সাথে দেখা করেন – একমাত্র বিশ্ব নেতা যিনি পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন4। পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে মে ৮-৯ তারিখের মাঝের রাতে ৩০০-৪০০ তুরস্ক-নির্মিত ড্রোন ভারতীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, যার উদ্দেশ্য “সম্ভবত ভারতের বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষা করা এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা”।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মোকাবেলায় ভারত নিজের কূটনৈতিক ও সামরিক কৌশল পুনর্বিন্যাস করেছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে, ভারত গ্রীস-সমর্থিত সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করছে, যা তুরস্ক ও পাকিস্তানের অবস্থানের বিপরীতে। গ্রীসের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো দুই দেশের যৌথ নৌ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।

দক্ষিণ ককেশাসে, ভারত আর্মেনিয়ার একটি শক্তিশালী সামরিক সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে আজারবাইজানের সাথে নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব চলছ। ২০২৪ সালের শেষের দিকে, ভারত এমনকি রাশিয়াকেও ছাড়িয়ে আর্মেনিয়ার বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান, তুরস্ক-সমর্থিত আজারবাইজানের সাথে সারিবদ্ধ হয়ে ২০২৪ সালের শেষের দিকে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের একটি অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

আরও বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তান এবং তুরস্ক উভয়ই বিশ্বব্যাপী কৌশলগত পরিবর্তনের দিক থেকে ভারতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে আফগানিস্তান-কেন্দ্রিক অংশীদারিত্ব থেকে ভারতের সাথে ইন্দো-প্যাসিফিক-কেন্দ্রিক শক্তিশালী অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত হয়েছে6। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে পাকিস্তানের নাম একবারও উল্লেখ করা হয়নি, অথচ ভারত অন্তত পাঁচবার উল্লেখিত হয়েছে।

অন্যদিকে, পরিকল্পিত ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক কোরিডোর (IMEC) তুরস্ককে বাদ দিয়ে চলেছে, যা ঐতিহাসিকভাবে নিজেকে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সেতু হিসেবে দেখে। IMEC এরদোগানের স্পষ্ট সমালোচনা পেয়েছে এবং তুরস্কের নিজের এশিয়া-ইউরোপ করিডোর (তথাকথিত ‘ইরাক ডেভেলপমেন্ট রোড’) প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করেছে।

এখন, তুরস্ক পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক জোটের একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী অংশে পরিণত হয়েছে যা ভারতের ক্ষতির জন্য কাজ করে, চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ২০২৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তুরস্কের প্রতি ভারতের মানবিক সহায়তা অঙ্কারার নয়া দিল্লির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেনি, যা ভারত-তুরস্ক সম্পর্কে পাকিস্তান ফ্যাক্টরের শক্তির প্রমাণ দেয়।

এই পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, ভারতকে এখন তার নিরাপত্তা কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে কূটনৈতিক সমর্থন পর্যন্ত তুরস্ক-পাকিস্তান সম্পর্কের গতিশীলতা ভারতের জন্য একটি পরিবর্তিত নিরাপত্তা পরিদৃশ্য তৈরি করেছে। আঞ্চলিক শক্তি ভারসাম্যকে স্থিতিশীল করতে এবং সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমিত করতে ভারতের আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন হবে।

About Author
Avatar

আমাদের স্টাফ রিপোর্টারগণ সর্বদা নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে আপনি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পেতে পারেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিশ্রুতি আমাদের ওয়েবসাইটকে একটি বিশ্বস্ত তথ্যের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।তারা নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ে বিশ্বাসী, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন তৈরিতে সক্ষম