US-India trade relations 2025: ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে, যেখানে ২০২৪-২৫ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১১৮.২ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৯.৮৫ লাখ কোটি টাকা) ছাড়িয়েছে। আমেরিকা বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর পণ্য আমদানি করছে, যার মধ্যে খনিজ তেল, মূল্যবান পাথর, যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম প্রধান।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের প্রধান আমদানি পণ্য
ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে পণ্যগুলো আমদানি করে তার মধ্যে খনিজ তেল ও জ্বালানি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ১২.৯ বিলিয়ন ডলার (১.১০ লাখ কোটি টাকা) মূল্যের খনিজ তেল ও জ্বালানি আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির একটি বড় অংশ।এর পরেই রয়েছে মূল্যবান পাথর ও অর্ধ-মূল্যবান পাথর, যার পরিমাণ প্রায় ৫.১৬ বিলিয়ন ডলার (০.৪৪ লাখ কোটি টাকা)।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতের যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট আমদানির পরিমাণ ৩.০৪৯ বিলিয়ন ডলার, যা জানুয়ারী মাসের ৩.৫৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে কিছুটা কম। অবশ্য, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কে ভারতের অনুকূলে ৩৬.৮ বিলিয়ন ডলার (৩.০৬ লাখ কোটি টাকা) বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে।
প্রধান আমদানিকৃত পণ্যসমূহ:
-
খনিজ তেল ও জ্বালানি (Mineral fuels & oils): ১২.৯ বিলিয়ন ডলার
-
মূল্যবান পাথর (Pearls & Semi-precious stones): ৫.১৬ বিলিয়ন ডলার
-
পারমাণবিক রিয়েক্টর ও যন্ত্রপাতি (Nuclear reactors & machinery): ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার
-
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি (Electrical machinery & equipment): ২.৩৮ বিলিয়ন ডলার
-
অপটিক্যাল, ফটোগ্রাফিক ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি: ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার
-
জৈব রাসায়নিক (Organic Chemicals): ১.৪২ বিলিয়ন ডলার
খনিজ তেল ও জ্বালানি আমদানি: ভারতের শক্তি নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
ভারতের জ্বালানি চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে এই খাতে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩.৪১ বিলিয়ন ডলার। আমদানিকৃত পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ক্রুড অয়েল, অ্যানথ্রাসাইট কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। উল্লেখযোগ্যভাবে, এপ্রিল-নভেম্বর ২০২৪ সময়কালে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯.৯৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ তেল ও জ্বালানি আমদানি করেছে।
বর্তমানে ভারত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বিপুল পরিমাণে জ্বালানির প্রয়োজন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই খাতে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে দুই দেশ নিরন্তর আলোচনা চালাচ্ছে। শক্তি নিরাপত্তা ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর মাধ্যমে ভারত তার শক্তি উৎসগুলিকে বিবিধ করার চেষ্টা করছে।
প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি আমদানি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানি খাত হলো যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত সরঞ্জাম। ২০২৩ সালে পারমাণবিক রিয়াক্টর, বয়লার, এবং যান্ত্রিক সরঞ্জাম আমদানির পরিমাণ ছিল ৫.৪৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ সালে এই পরিমাণ ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।এপ্রিল-নভেম্বর ২০২৪ সময়কালে ভারত ২.৮১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে।
ভারতের উৎপাদন খাত, বিশেষ করে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে, উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি আমদানিতেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে, যেখানে ২০২৪-২৫ সালে ২.৩৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করা হয়েছে।
মূল্যবান পাথর ও এর গুরুত্ব
ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মূল্যবান পাথর ও অর্ধ-মূল্যবান পাথর আমদানি করে। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১.৮৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে ৫.১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এপ্রিল-নভেম্বর ২০২৪ সময়কালে ভারত ৩.২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মূল্যবান পাথর আমদানি করেছে।
এই আমদানি ভারতের অলংকার শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা বিশ্বের বৃহত্তম হীরা কাটাই ও পলিশিং কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি। এই খাতে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিও উল্লেখযোগ্য, ২০২৩ সালে যার পরিমাণ ছিল ১০.১৭ বিলিয়ন ডলার।
মেডিকেল ও অপটিক্যাল যন্ত্রপাতি
চিকিৎসা সেবার উন্নতির জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে অপটিক্যাল, ফটোগ্রাফিক ও মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানি করে, যার মূল্য ২০২৩ সালে ছিল ২.৩০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১.৮৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্যসেবা খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, এবং অত্যাধুনিক মেডিকেল যন্ত্রপাতির চাহিদা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র এই চাহিদা পূরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করছে।
জৈব রাসায়নিক ও প্লাস্টিক আমদানি
ভারতের রাসায়নিক শিল্প খাতের চাহিদা পূরণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জৈব রাসায়নিক আমদানি করা হয়। ২০২৩ সালে এই খাতে আমদানির পরিমাণ ছিল ১.৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১.৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
এছাড়াও, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্লাস্টিক আমদানি করে, যার মূল্য ২০২৩ সালে ছিল ২.১১ বিলিয়ন ডলার। এই জৈব রাসায়নিক ও প্লাস্টিক ভারতের ঔষধ শিল্প, কৃষি খাত এবং নির্মাণ শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিমান ও মহাকাশযান সামগ্রী
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য আমদানি খাত হলো বিমান ও মহাকাশযান সামগ্রী, যার মূল্য ২০২৩ সালে ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার ছিল। ভারতের বিমান চলাচল খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে, এবং দেশীয় এয়ারলাইনগুলো নতুন বিমান কিনছে, যার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়।
এছাড়া, ভারতের মহাকাশ গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়।
লোহা ও ইস্পাত আমদানি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমদানি খাত হলো লোহা ও ইস্পাত, যার মূল্য ২০২৩ সালে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার ছিল। ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অবকাঠামো খাতের চাহিদা পূরণে এই আমদানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লোহা ও ইস্পাত ভারতের নির্মাণ শিল্প, অটোমোবাইল শিল্প এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। ভারত নিজেই একটি বড় ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ, তবে কিছু বিশেষ ধরনের ইস্পাত ও লোহা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়।
বর্তমান বাণিজ্য প্রবণতা ও ট্রাম্পের শুল্ক নীতি
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর ২৬% অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন, যা ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি মূলত “পারস্পরিক শুল্ক” (reciprocal tariffs) নীতি চালু করেছেন, যার লক্ষ্য উভয় দেশের মধ্যে শুল্কের ভারসাম্য আনা।
এই শুল্ক নীতির কারণে ২০২৫ সালে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি প্রায় ৫.৭৬ বিলিয়ন ডলার (৬.৪১%) কমতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যদিও এটি প্রধানত ভারতের রপ্তানি খাতে প্রভাব ফেলবে, তবে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কে এর প্রভাব পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা: ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলার
বর্তমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে দুই দেশ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে একসাথে কাজ করছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (IPEF) এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি দেশ: রাশিয়া থেকে আলজেরিয়া পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী রাষ্ট্রগুলি
আমদানি খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের আমদানি খাতে বেশ কিছু সম্ভাবনা রয়েছে:
-
প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম: ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে ২০২৫ সালে একটি চুক্তি করেছে, যার ফলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি বাড়তে পারে।
-
নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি: ভারত নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, এবং এই খাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নত প্রযুক্তি আমদানির সম্ভাবনা রয়েছে।
-
ক্রিটিক্যাল মিনারেলস: লিথিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ সম্পর্কে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সহযোগিতা চুক্তি করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যা উভয় দেশের মধ্যে এই খাতে বাণিজ্য বাড়াতে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের আমদানিতে খনিজ তেল ও জ্বালানি, মূল্যবান পাথর, যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, জৈব রাসায়নিক, এবং লোহা ও ইস্পাত প্রধান স্থান দখল করে আছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতের যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোট আমদানির পরিমাণ ৪০.৭ বিলিয়ন ডলার (৩.৩৯ লাখ কোটি টাকা)।
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে শুল্ক নীতি নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে উভয় দেশই বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তি, এবং ক্রিটিক্যাল মিনারেলস খাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বাড়তে পারে। এই সম্পর্ক উভয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।