আলসার কত দিনে ভালো হয় – এই প্রশ্নটি যাদের বা তাদের প্রিয়জনের পেপটিক আলসার হয়েছে, তাদের মনে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। পেটের ভেতর বা ক্ষুদ্রান্ত্রের শুরুতে সৃষ্ট এই বেদনাদায়ক ক্ষত বা ঘা জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মকানুন মেনে চললে বেশিরভাগ আলসারই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
সাধারণভাবে, একটি সাধারণ বা জটিলতাহীন আলসার পুরোপুরি সারতে ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। তবে এই সময়কালটি নির্দিষ্ট নয় এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে, যেমন – আলসারের ধরন, এর পেছনের কারণ, রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা পদ্ধতি।
এই প্রবন্ধে আমরা আলসার নিরাময়ের সময়কাল, এর পেছনের বিজ্ঞান, দ্রুত আরোগ্যের উপায় এবং আলসার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সকল তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আলসার নিরাময়ের সময়কাল: ধরন এবং কারণ ভেদে ভিন্নতা
আলসার ভালো হওয়ার সময় মূলত দুটি প্রধান বিষয়ের উপর নির্ভর করে: আলসারের অবস্থান (পাকস্থলী বা ডুওডেনাম) এবং এর পেছনের মূল কারণ (যেমন, H. pylori ব্যাকটেরিয়া বা ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহার)।
১. গ্যাস্ট্রিক আলসার (পাকস্থলীর আলসার)
পাকস্থলীর ভেতরের আবরণে যে আলসার হয়, তাকে গ্যাস্ট্রিক আলসার বলা হয়। সাধারণত, সঠিক চিকিৎসায় গ্যাস্ট্রিক আলসার সারতে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে, আলসার সেরে গেছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য ৪-৬ সপ্তাহ পর একটি ফলো-আপ এন্ডোস্কোপি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
২. ডুওডেনাল আলসার (ক্ষুদ্রান্ত্রের আলসার)
এটি ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশ, অর্থাৎ ডুওডেনামে সৃষ্টি হয়। গ্যাস্ট্রিক আলসারের তুলনায় ডুওডেনাল আলসার সাধারণত দ্রুত সারে। সঠিক চিকিৎসায় এটি পুরোপুরি নিরাময় হতে প্রায় ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় নেয়।
কারণ ভেদে নিরাময়ের সময়:
- এইচ. পাইলোরি (Helicobacter pylori) জনিত আলসার: পেপটিক আলসারের একটি বড় অংশের জন্য দায়ী এই ব্যাকটেরিয়া। H. pylori সংক্রমণ ধ্বংস করার জন্য সাধারণত ৭ থেকে ১৪ দিনের একটি অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স দেওয়া হয়। এর সাথে অ্যাসিড কমানোর জন্য প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (PPI) জাতীয় ঔষধ দেওয়া হয় যা ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার সফল নির্মূলের পর আলসার দ্রুত সারতে শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সফল H. pylori ইরাডিকেশন থেরাপির পর আলসার পুনরাবৃত্তির হার নাটকীয়ভাবে কমে যায়।
- ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs) জনিত আলসার: নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) যেমন – আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, অ্যাসপিরিন ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের ফলে পাকস্থলীর প্রতিরক্ষামূলক স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আলসার হতে পারে। এক্ষেত্রে, প্রথমেই সেই ব্যথানাশক ওষুধ বন্ধ করতে হবে বা বিকল্প ওষুধের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এর সাথে ৮ সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে PPI সেবনের মাধ্যমে আলসার নিরাময় করা হয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি এবং আরোগ্যের সময়কাল
আলসারের চিকিৎসায় মূলত এর কারণ দূর করা এবং পাকস্থলীর অ্যাসিডের পরিমাণ কমিয়ে ক্ষতকে সারার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়।
কোন কোন কারণে আলসার সারতে দেরি হতে পারে?
কিছু বিষয় আলসার নিরাময় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে। এগুলোকে “রিফ্র্যাক্টরি আলসার” (Refractory Ulcer) বলা হয়, যা ৮-১২ সপ্তাহের চিকিৎসাতেও সারে না।
- ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ না করা: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সম্পূর্ণ কোর্স ওষুধ না খাওয়া আলসার না সারার অন্যতম প্রধান কারণ।
- অব্যাহত NSAID ব্যবহার: চিকিৎসকের অজান্তে ব্যথানাশক ওষুধ চালিয়ে যাওয়া।
- ধূমপান: ধূমপান পাকস্থলীতে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয় এবং অ্যাসিড উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে, যা আলসার সারাতে বাধা দেয়।
- অত্যধিক মদ্যপান: অ্যালকোহল পাকস্থলীর মিউকাস লাইনিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং আলসারের ঘা বাড়িয়ে তোলে।
- অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: কিছু ক্ষেত্রে, H. pylori ব্যাকটেরিয়া প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, ফলে সংক্রমণ দূর হয় না।
- অন্যান্য রোগ: ক্রোন’স ডিজিজ (Crohn’s disease) বা জোলিঞ্জার-এলিসন সিনড্রোম (Zollinger-Ellison syndrome)-এর মতো বিরল রোগেও আলসার হতে পারে যা সহজে সারতে চায় না।
- আলসারের আকার: বড় আকারের আলসার সারতে স্বাভাবিকভাবেই বেশি সময় লাগে।
- মানসিক চাপ: যদিও মানসিক চাপ সরাসরি আলসারের কারণ নয়, তবে এটি উপসর্গ বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং নিরাময় প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিতে পারে।
দ্রুত আরোগ্যের জন্য করণীয়: পথ্য ও জীবনযাত্রা
শুধুমাত্র ওষুধই নয়, জীবনযাত্রায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনলে আলসার দ্রুত সেরে ওঠে এবং ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তির ঝুঁকিও কমে।
খাদ্যাভ্যাস:
- অল্প পরিমাণে বারবার খাওয়া: একবারে পেট ভরে না খেয়ে, দিনে ৫-৬ বার অল্প পরিমাণে খাবার খান।
- সহজপাচ্য খাবার: সেদ্ধ, নরম এবং কম মশলাযুক্ত খাবার খান। খিচুড়ি, জাউভাত, স্যুপ ইত্যাদি উপকারী।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: আপেল, ওটস, গাজর, বিনস-এর মতো ফাইবারযুক্ত খাবার হজমে সাহায্য করে।
- প্রোবায়োটিক: দই-এর মতো প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং H. pylori নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
- ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার: ভিটামিন এ এবং সি ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। মিষ্টি আলু, পালং শাক, বেল পেপার, লেবু ইত্যাদি খেতে পারেন।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলবেন:
- অতিরিক্ত তেল ও মশলা: ভাজাভুজি, অতিরিক্ত ঝাল ও মশলাযুক্ত খাবার পাকস্থলীতে অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
- অ্যাসিডিক ফল: লেবু, কমলা, আনারসের মতো টক ফল খালি পেটে খাবেন না।
- কফি ও ক্যাফেইন: চা, কফি, কোমল পানীয় এবং চকোলেট উপসর্গ বাড়াতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্যাকেটজাত এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন।
- অ্যালকোহল ও ধূমপান: এগুলো কঠোরভাবে বর্জনীয়।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
আলসারের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবিলম্বে হাসপাতালে যোগাযোগ করুন, কারণ এগুলো জটিলতার লক্ষণ হতে পারে:
- হঠাৎ পেটে তীব্র ও অসহ্য ব্যথা।
- কফির গুঁড়োর মতো বা লাল রক্ত বমি হওয়া।
- আলকাতরার মতো কালো ও আঠালো পায়খানা।
- শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা জ্ঞান হারানো।
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা শুরু হলে আলসারের মতো রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই অবহেলা না করে সচেতন হন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. আলসার কি সম্পূর্ণ ভালো হয়?
হ্যাঁ, সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে পেপটিক আলসার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। এর মূল কারণ (যেমন H. pylori বা NSAID ব্যবহার) দূর করা হলে এবং নিয়মিত ওষুধ সেবন করলে আলসার পুরোপুরি সেরে যায়।
২. ঘরোয়া উপায়ে কি আলসার ভালো করা সম্ভব?
ঘরোয়া উপায় যেমন – মধু, কলা, বা বাঁধাকপির রস উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু এগুলো আলসারের মূল চিকিৎসা নয়। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বা অন্য কোনো গভীর কারণ থাকলে শুধুমাত্র ঘরোয়া উপায়ে এটি সারানো সম্ভব নয় এবং জটিলতা বাড়তে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শই প্রধান।
৩. আলসারের ওষুধ কতদিন খেতে হয়?
সাধারণত, অ্যাসিড কমানোর ওষুধ (PPIs) ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ এবং H. pylori সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ৭ থেকে ১৪ দিন খেতে হয়। তবে রোগের তীব্রতা এবং কারণের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক সময়কাল নির্ধারণ করবেন।
৪. মানসিক চাপ থেকে কি আলসার হয়?
সরাসরি মানসিক চাপ আলসারের কারণ না হলেও, এটি বিদ্যমান আলসারের উপসর্গকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং নিরাময় প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। মানসিক চাপ পাকস্থলীতে অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়।
৫. আলসার থেকে কি ক্যান্সার হতে পারে?
দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা না করা H. pylori জনিত গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে পাকস্থলীর ক্যান্সারের ঝুঁকি সামান্য বাড়তে পারে। তবে ডুওডেনাল আলসার থেকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সময়মতো চিকিৎসা করানো অত্যন্ত জরুরি।
৬. আলসারের ব্যথা সাধারণত পেটের কোন দিকে হয়?
আলসারের ব্যথা সাধারণত পেটের উপরের অংশে, মাঝ বরাবর বা সামান্য বাম দিকে অনুভূত হয়। খালি পেটে বা রাতে ব্যথা বাড়তে পারে এবং খাওয়ার পর সাময়িকভাবে কমতে পারে।